তথ্য প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন: আইসিটি প্রতিমন্ত্রী
কিশোরী ও যুব নারীদের তথ্য প্রযুক্তি খাতে দক্ষ ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বিজ্ঞান, প্রকৌশল, গণিত, প্রযুক্তির মত বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্তকরণ। এছাড়াও ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের সুযোগ ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে তাদের জন্য গড়ে তোলা প্রয়োজন কর্মমূখী শিক্ষাব্যবস্থা।
বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) 'এক্সেলেরিটিং ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর গার্লস অ্যান্ড উইমেন' শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
ইন্টারন্যাশনাল গার্লস ইন আইসিটি দিবস ২০২১ উপলক্ষ্যে, এটুআই, গ্রামীণফোন এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যৌথভাবে এই আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, "এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নিরাপদ অনলাইন বিশ্বে কিশোরী ও যুব নারীদের ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করতে চ্যালেঞ্জ ও করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা।"
তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে কিশোরী ও যুব নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগ বৃদ্ধিতে ও তাদের এই খাতে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর এপ্রিলের ৪র্থ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটি পালিত হয়।
প্রতিমন্ত্রী পলক বলেন, বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তিতে প্রোগ্রামিং এবং কোডিং এর গুরুত্ব বাড়ছে। মেয়েদের তথ্য প্রযুক্তি খাতে সফল করতে প্রাথমিক শিক্ষাতে এই বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। তাই আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রোগ্রামিং ও কোডিং বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, "৩৫ হাজার আধুনিক ডিজিটাল ল্যাব গঠন করা হবে যা কিশোরী ও যুব নারীদের এই খাতে আরো আগ্রহী করে তুলতে আরো সহজে অংশগ্রহণে সহায়তা করবে।"
পাশাপাশি এই খাতে কিশোরী ও যুব নারীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিতে মেন্টরিং ও মনিটরিং এ সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাইকে একত্রে কাজ করার আহবান জানান তিনি।
তিনি জানান, প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার পাশাপাশি আইসিটি খাতে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ সরকার।
আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তরুণ প্রতিনিধি তুসাব্বের মুনতাহা, আসাদুজ্জামান আসাদ, সাফা জারিন, স্টার্টআপ বাংলাদেশ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিনা এফ জাবীন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সভাপতি জনাব সৈয়দ আলমাস কবির, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (ব্যাকো)-এর সভাপতি জনাব ওয়াহিদ শরীফ এবং ব্র্যাক-এর সিনিয়র ডিরেক্টর জনাম কে এ এম মোর্শেদ।
আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স এবং মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর লাফিফা জামাল। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গ্রামীণফোনের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা জনাব সৈয়দ তানভীর হোসেন এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর অরলা মার্ফি।
আলোচনায় অংশগ্রহণকালে আলোচকরা নিরাপদ অনলাইন নিশ্চিতে সমাধান পরিকল্পনা থেকে শুরু করে তথ্য-প্রযুক্তির সকল স্তরে কিশোরী ও যুব নারীদের বৃহত্তর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের প্রতি জোর দেন।
তরুণ প্রতিনিধি সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন ডিজএবিলিটি (সিএসআইটি)-এর তুসাব্বের মুনতাহা বলেন, "তথ্য প্রযুক্তি খাতে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এবং নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারি পর্যায়ে অনেক কাজ রয়েছে। এ খাতে প্রতিবন্ধী নারীদের কর্মসংস্থানে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকার পরও তুলনামূলক কম পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিবন্ধী নারীদের প্রযুক্তিগত ও প্রশিক্ষণগত সহায়তা প্রদান তাদের এই খাতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।" অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ নিশ্চিতে এই খাতে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান নিশ্চিতের জন্য যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।
টিনা এফ জাবীন বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি তথা আইসিটি খাতে বর্তমানে যেসকল সফল নারী উদ্যোক্তা আছেন তাদের সমাজে এগিয়ে আসতে হবে অন্যদের উৎসাহিত করতে। কিশোরী ও যুব নারীদের অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে এই খাতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং সেই সাথে সকল স্তরে নেতৃত্বে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশী জরুরি দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তন। নারীর নিরাপত্তা সর্বস্তরে নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।
সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে আইসিটি খাতে মাত্র ১২-১৩ শতাংশ নারী। উদ্যোক্তা খাতে এই সংখ্যা আরো কম, ২-৩ শতাংশ। নানা আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, প্রযুক্তির প্রতি, বিশেষ করে গণিতের প্রতি একটা ভীতি কাজ করে। তবে এই ভীতি সমাজ সৃষ্ট। সামাজিক একটা পরিবর্তন তাই এখানে অত্যন্ত জরুরি।
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের কর্মসংস্থানের বড় পরিসরে সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে শহরে নারীরা অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠছেন এবং এফ কমার্স ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। এফ-কমার্সে প্রায় ৫০ শতাংশ নারী- এটা একটা আশা জাগানোর মত বিষয়।"
সকলের মিলিত প্রয়াসের উপর জোর দিয়ে ওয়াহিদ শরীফ বলেন, যেকোন প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্তরের ব্যবস্থাপনায় নারীর উপস্থিতি এখনো অনেক কম। এই হার বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নজর দিতে হবে শিক্ষা খাতেও। পড়াশোনা থেকে শুরু করে চাকরি খাতে প্রবেশের সময় নারীরা যথাযথ যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে আসতে পারছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। পারিবারিক বাধা দূর করে নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ সামাজিক ও কর্মপরিবেশ।
সঞ্চালনাকালে অধ্যাপক লাফিফা জামাল বলেন, আমাদের ধারণা, যা কিছু কঠিন তা নারীদের জন্য নয়। এই ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। মেধাস্বত্ব বিচারে নারী-পুরুষ সবাই সমান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রণোদনা দানের পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়েও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনায় আর্থিক প্রণোদনা প্রদান একটি সমাধান হতে পারে যার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারে আইসিটি খাতে কিশোরী ও যুব নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অরলা মার্ফি বলেন, নারীর নেতৃত্ব এবং সমতা নিশ্চিতে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ এবং শক্তিশালী পার্টনারশিপের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় দিক নিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কাজ করতে ইচ্ছুক। প্রযুক্তির প্রভাব আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে এবং বৈশ্বিক মহামারি আমাদের আরো পরিষ্কার ভাবে এই খাতের জেন্ডার বৈষম্য বিদ্যমান চিত্র অনুধাবন করিয়েছে। আমরা লিঙ্গ বৈষম্য মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি না। "মেয়ে আমি সমানে সমান" প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের একটি বিশ্বব্যাপী প্রচারণা যেখানে মূল উদ্দ্যেশ্যের একটি হল, মেয়েদের অনলাইনে স্বাধীনতা অর্জন করা।"
অরলা আরো বলেন, ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাখাতে বাংলাদেশ ভালো অগ্রগতি করেছে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৮ শতাংশে। তবে অষ্টম শ্রেণির দিকে তাকালেই দেখা যায় যে এই পর্যায়ে এসে প্রায় ৩৬ শতাংশ মেয়েরা স্কুল থেকে ঝরে পরছে,সেখানে একই পর্যায়ে ছেলেদের ঝরে পরার হার ৫ শতাংশ। একটা মেয়ে শিশু প্রথমতই খুব ছোটবেলা থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এর সূত্র মতে, এখনও ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মোট ৪১ শতাংশ যুব কোনরকম শিক্ষা, চাকরি বা প্রশিক্ষণে নেই। যার মধ্যে ৬৫.৭% নারী এবং ১৭.৯% পুরুষ। অরলা আহ্বান জানান, সমাজের সর্বস্তরকে সংযোগ করে কাজ করার সুযোগ তৈরিতে। প্রযুক্তি খাতে মেয়ে এবং যুবতী নারীদের অনুপ্রাণিত করার জন্য নারী নেতৃতবকে আরও বেশি দৃশ্যমান করতে।
সৈয়দ তানভীর বলেন, বৈশ্বিক ভাবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ অনুপাতে একটা ব্যবধান রয়েছে। এই সমস্যাটা শুধুমাত্র আজকের নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যত নির্ধারণেও প্রভাব ফেলবে। সামনের দিনে অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রই তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠবে। তাই আজকে আমরা নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে যেসকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা গিয়ে ভবিষ্যতের জনশক্তি গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখবে। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছি, যাতে নারীরা এই সেক্টরে আসতে আগ্রহী হয়। এরপর জরুরি দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া।এই খাতে নেতৃত্ব গ্রহণেও তাদের উৎসাহিত করতে হবে।
আলোচকদের সকলেই আইসিটি খাতে নারীদের কাজ করার বিশাল সম্ভাবনা ও সুযোগকে কাজে লাগাতে এবং নারীদের এই খাতে অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকারি ও বেসরকারি মিলিত উদ্যোগ, প্রণোদনা এবং প্রশিক্ষণের মত পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি নিশ্চিত করা হবে নিরাপদ কর্মপরিবেশ।