কন্ঠস্বর শুনেই সংক্রমণ শনাক্ত করবে নতুন এআই অ্যাপ
করোনাভাইরাস অতিমারি আকার ধারণ করছে, গত মার্চ নাগাদ তার ইঙ্গিত পায় বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ তখন জনগণের প্রতি প্রাণঘাতী জীবাণুর সংক্রমণ রুখে দেওয়ার লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। স্রোতের ন্যায় রোগীর চাপের মুখে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাস্ক ও অন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম অনুদান চায় হাসপাতালগুলো।
পিছিয়ে ছিলেন না গবেষকরাও। তারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর- সেরে ওঠাদের থেকে তাদের রক্তরস বা প্লাজমা দানের অনুরোধ করছিলেন। ইসরায়েলে অবশ্য ভিন্নতর এক আহ্বান জানায়- ভোকালিস হেলথ নামের একটি প্রযুক্তি স্টার্ট-আপ। তার জনগণের কাছে তাদের কণ্ঠস্বর দানে! অনুরোধ করে।
বিষয়টি অবশ্য খুবই সাধারণ। সেজন্য কোম্পানিটি সম্পর্কে একটু জানা দরকার।
ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই দপ্তর আছে ভোকালিসের। ইতোপূর্বে, তারা এমন একটি স্মার্টফোন অ্যাপ চালু করে, যা ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। অ্যাপ ব্যবহারকারীরা কথা বলার সময় ঠিকঠাক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন কিনা- তা গলার স্বর শুনেই শনাক্ত করে অ্যাপটি। ওই প্রযুক্তিকেই কোভিড-১৯ বিরোধী যুদ্ধে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেয় কোম্পানিটি।
অ্যাপটি কীভাবে কাজ করে?
করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের ভোকালিসের গবেষণামূলক অ্যাপ ডাউনলোড করে তাদের কণ্ঠস্বরের নমুনা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। দিনে অন্তত একবার তারা অ্যাপটি চালু করে, ফোনে ভেসে ওঠা একটি ছবির বর্ণনা দেন এবং এক থেকে ৫০ বা ৭০ পর্যন্ত সংখ্যা গণনা করেন।
রোগীদের কণ্ঠস্বরের এসব নমুনার রেকর্ডিং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সাহায্যে কোভিড আক্রান্ত নন, এমন ব্যক্তিদের কন্ঠস্বরের সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির কণ্ঠস্বর পরিচিতি বা ভয়েসপ্রিন্ট তৈরির জন্যই এ পদ্ধতি।
উদ্যোগটি বেশ সফল হয় বলা চলে। চলতি গ্রীষ্মের মাঝামাঝি নাগাদ প্রায় দেড় হাজার নমুনা থেকে কোভিড-১৯ শনাক্তের একটি পরীক্ষামূলক বা পাইলট সংস্করণ তৈরি করেছে কোম্পানিটি।
তাদের তৈরি এ প্রযুক্তির যন্ত্রটি এখন বিশ্বব্যাপী সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ে কতটা কাজ করে- তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। অবশ্য, এটি সরাসরি সংক্রামক ব্যাধিটি শনাক্ত করার পদ্ধতি নয়, বরং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন- এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের পরীক্ষা করার উদ্যোগকে শক্তিশালী করবে। যার ফলে রোগীর পরীক্ষা, কোয়ারেন্টিনে রাখা বা ব্যক্তিগত পরিচর্যার জন্য বাড়তি তথ্যের সহায়তা পাবেন তারা।
'আমাদের তৈরি এআই অ্যালগরিদম কী চিকিৎসা খাতে সহায়তা করবে' নিজেই এমন প্রশ্ন রাখেন ভোকালিসের প্রেসিডেন্ট এবং মুখ্য নির্বাহী তাল ওয়েন্ডেরো। উত্তর নিজেই দিয়ে বলেছেন, ''এটা কোনো নিবিড় পরীক্ষা পদ্ধতি নয়, এমনকি ওষুধও নয়। আমরা কিছুই পরিবর্তন করছি না। তবে নিজেকে বা অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসার ইচ্ছে থাকলে, শুধু এটি ব্যবহার করে কথা বললেই হবে।''
সম্ভবনার নতুন খাত:
তবে একমাত্র ভোকালিস-ই কণ্ঠস্বর কেন্দ্রিক বায়ো-ডিভাইস নির্মাতা নয়। বিশ্বজুড়ে কমপক্ষে আরও তিনটি গবেষক দল একই ধরনের কোভিড প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবক দল আবার কোভিড-১৯ আক্রান্তের কাশির ধরন বা ফেসমাস্ক পড়ে কথা বলার সময় তাদের কণ্ঠস্বর কেমন শোনায়- তা শনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে কণ্ঠস্বর পরীক্ষা ও রোগ শনাক্তের খাতটি তুলনামূলক নবীন। কিন্তু, আলোচিত উদ্যোগগুলো এখাতে তীব্র বিকাশের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরছে।
ইতোপূর্বে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সাহায্যে হৃদরোগ ,স্মৃতি বিভ্রম, হতাশা বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতার লক্ষ্মণ ইত্যাদি শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। সেখানে অনেকক্ষেত্রেই প্রযুক্তির ব্যবহার ইতিবাচক সম্ভাবনা দেখিয়েছে।
এসব প্রযুক্তি যখন কণ্ঠস্বর চিহ্নের সঙ্গে সম্মীলন ঘটানো হয়, তখন নানা রোগের উপসর্গে আক্রান্ত ব্যক্তির কথাবার্তায় সামান্যতম ব্যবধান ফুটে ওঠে। সেই সফলতা থেকেই এখন বিশ্বজুড়ে অনেক কোম্পানি স্বাস্থ্যখাতে কন্ঠস্বর চিহ্নের বাণিজ্যিক ব্যবহার চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে।
স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের অফিসে ব্যবহার করার মতো তথ্য-প্রযুক্তির উপকরণ তৈরির দিকে এপর্যন্ত অধিকাংশ গবেষণা দল অনেকটা ঢিমেতালে এবং ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছেন।
অবশ্য কেউ কেউ এখনই এটি ব্যাপক আকারে চালু করার ইচ্ছে পোষণ করছে। মুঠোফোনের মতো ভোক্তাপণ্যে সহজলভ্য মাইক্রোফোনের সাহায্যে ক্রেতাদের দান করা বিনামুল্যের কণ্ঠস্বরের নমুনাকে কাজে লাগিয়েই তারা আগামী দিনে রোগ শনাক্তের নতুন দিগন্তের কথা জানাচ্ছে।
- সূত্র: নেচার ডটকম
- অনুবাদ: নূর মাজিদ