করোনা ভ্যাকসিন: ইতিহাসের দ্রুততম টিকা
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান রাজ্য থেকে সারা বিশের ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি কোভিড-১৯। গত নয় মাসে এই ভাইরাসে ৯ লাখ ৮১ হাজার ৯৬২ জন মারা গেছে।আক্রান্ত হয়েছেন ৩ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। বাংলাদেশে এরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ৫ হাজার বাসিন্দা। এর মধ্যেই অস্থির হয়ে পড়েছি আমরা, বিশ্বজুড়ে আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি করোনা প্রতিষেধকের জন্য- 'কবে আসবে করোনা ভ্যাকসিন'?
এরমধ্যেই তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রোজেনেকা ও যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার করোনা প্রতিষেধক। রাশিয়ার 'স্পুটনিক-ভি'ও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হতে চলেছে। করোনাভাইরাস রুখতে তাদের দ্বিতীয় টিকা 'এপিভ্যাককরোনা'ও শীঘ্রই আসছে। যার প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা সেপ্টেম্বরে হয়ে যেতে পারে। প্রায় ৬০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে জনসন অ্যান্ড জনসনের তৈরি সম্ভাব্য টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হতে চলেছে। এই টিকার বিশেষত্ব হল, এর একটিই ডোজ কার্যকরী হবে। আগামী বছরে টিকার ১০০ কোটি ডোজ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে জনসন অ্যান্ড জনসনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার ইতিহাসে এত দ্রুত গতিতে অন্য কোনও ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি। তবে করোনা ভ্যাকসিনের জন্য আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।''
তারা বলছেন, আগে বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না। ফলে অনেক সময় লেগে যেত কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করতে। তবে যেকোন ভ্যাকসিন শুধু গবেষণাগারে তৈরি হলেই হয় না, কয়েকটি ধাপে এর কার্যকারিতা যাচাই করে নিতে হয়। প্রথমে নিম্নবর্গের প্রাণীর ওপর এবং তারপর তৃতীয় পর্যায়ে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে দেখা হয় এটি কাজ করছে কি না, কোন ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না। এভাবে নিরাপদ ভ্যাকসিন তৈরি হতে সময় প্রয়োজন হয়।
২০১৯ সালে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন ২০২১ সালেই অর্থাৎ এক বছরের মধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে এর প্রতিষেধক। ইতিহাসে আর কোন প্রতিষেধক এত দ্রুত সময়ের মধ্যে তৈরি হয়নি।
স্মল পক্স: কবে এর প্রথম সংক্রমণ জানা নেই। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেও এর অস্তিত্বের খবর শোনা যায়। ১৭৯৬ সালে এডওয়ার্ড জেনার প্রথম স্মল পক্সের টিকা আবিষ্কার করেন। কিন্তু এর ব্যবহার শুরু হতে ১৯৫০ সাল হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে সার্বিক ভাবে গোটা বিশ্বে ভ্যাকসিন তৈরি শুরু হয়। এখন স্মল পক্স সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন।
প্লেগ: পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও মারণ রোগ। অন্তত ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখনও এই রোগের কোনও ভ্যাকসিন লাইসেন্স পায়নি। ২০১৭ সালেও মাদাগাস্কারে প্লেগের আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। এখনও এর সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এমন ১৭টি পরীক্ষাধীন প্রতিষেধকের তালিকা বানিয়েছে।
টাইফয়েড: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্তমানে এর প্রকোপ বেশি। ১৮৮০ সালে প্রথম চিহ্নিত হয় ব্যাক্টিরিয়াটি। '৮৬ থেকে প্রতিষেধক তৈরির গবেষণা শুরু। ১৯০৯ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ফ্রেডেরিক এফ রাসেল প্রথম ভ্যাকসিন তৈরি করেন। বাজারে আসতে ১৯১৪। অর্থাৎ ৩৪ বছর সময় লেগেছে এই ভ্যাকসিন সাধারণের নাগালে আসতে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা: ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারি দেখা দেয়। ১৯৩০ সাল থেকে গবেষণা শুরু হয়। মহামারি দেখা দেবার ২৭ বছর পর ১৯৪৫ সালে প্রথম ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন তৈরি হয়। কিন্তু দু'বছর পরই দেখা যায় ওই ভ্যাকসিন কাজ করছে না। ভাইরাসের মধ্যে বদল ঘটে গিয়েছে। প্রধানত দু'ধরনের স্ট্রেন রয়েছে— ইনফ্লুয়েঞ্জা এ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বি। এখনও এর ভ্যাকসিন সময়ে-সময়ে প্রয়োজন মতো 'আপডেট' করতে হয়।
ইয়েলো ফিভার: এর ভ্যাকসিন তৈরি করে ১৯৫১ সালে নোবেল পুরস্কার পান ম্যাক্স টেলার। অন্তত ৫০০ বছর ধরে এই মহামারিতে ভুগেছে বিশ্ব। ১৯১৮ সালে রকফেলার ইনস্টিটিউট প্রথম ভ্যাকসিন তৈরি করে। কিন্তু ১৯২৬ সালে তা ভুল প্রমাণ করেন ম্যাক্স। আরও এক দশক পরে ১৯৩৭ সালে প্রথম কার্যকরী প্রতিষেধক তৈরি করেন তিনি।
পোলিও: উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রথম সংক্রমণ। ১৯৩৫ সালে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা শুরু। ১৯৫৩ সালে জোনাস সল্ক এবং ১৯৫৬ সালে অ্যালবার্ট সেবিন ভ্যাকসিন তৈরি করেন। ১৯৫৫ থেকে সল্কের প্রতিষেধক ব্যবহার শুরু করে মার্কিন সেনা। ১৯৮০তে আরও কার্যকরী প্রতিষেধক তৈরি। ১৯৯৪ সালে আমেরিকা থেকে নিশ্চিহ্ন। ২০১৮তে বিশ্বে ৩৩টি পোলিও কেস রয়েছে।
অ্যানথ্রাক্স: ৭০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে এর অস্তিত্বের খোঁজ মেলে। উনিশ শতক থেকে গবেষণা শুরু। ১৯৩৭ সালে মাক্স স্টার্ন প্রথম সফল ভ্যাকসিন তৈরি করেন। ১৯৭০ সালে আরও আধুনিক প্রতিষেধক তৈরি হয়।
চিকেন পক্স: উনিশ শতকের শেষ অবধি চিকেন পক্সকে 'স্মল পক্স' হিসেবেই ভুল করা হত। ১৯৫০ সালে একে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭০ সালে জাপানে প্রথম চিকেন পক্সের প্রতিষেধক তৈরি। আমেরিকায় প্রথম লাইসেন্স মেলে ১৯৯৫।
হেপাটাইটিস বি: ১৯৬৫ সালে ভাইরাসটি চিহ্নিত করেন বারুচ ব্লুমবার্গ। এর চার বছর বাদে প্রতিষেধক তৈরি করেন তিনি। এফডিএ-র ছাড়পত্র মেলে ১২ বছর বাদে। ১৯৮৬ সালে আরও আধুনিক ভ্যাকসিন। আপাতত তাই ধৈর্যের বিকল্প নেই।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা ও উইকিপিডিয়া