বিশ্বকাপের টানে মরুভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে কাতার যাত্রা করেছেন সৌদি ফুটবল ভক্ত!
ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই বিশ্বজুড়ে ভক্তদের নানা রকম উন্মাদনা। প্রিয় দলের খেলা দেখার জন্য কত রকম আত্মত্যাগই না করে ভক্তরা! তেমনই এক ভক্ত সৌদি আরবের আবদুল্লাহ আলসুলমি। নিজের বাড়িতে বসে একদিন টিভি শো দেখতে দেখতে মাথায় এক দুঃসাহসী চিন্তা আসে আবদুল্লাহর। সেদিন টিভি শোতে কাতারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছিলেন, আসন্ন কাতার বিশ্বকাপে দর্শকদের জন্য থাকবে একেবারেই ভিন্নরকম অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ। একথা শোনার পরেই আবদুল্লাহ ভাবেন- 'যেভাবেই হোক, আমাকে কাতারে পৌঁছাতেই হবে, সেটা পায়ে হেঁটে হলেও!'
যেই ভাবা সেই কাজ, ফুটবলের টানে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন ৩৩ বছর বয়সী আবদুল্লাহ। সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে কাতারের রাজধানীতে পৌঁছাতে তাকে একা পাড়ি দিতে হবে ১৬০০ কিলোমিটার পথ!
আব্দুল্লাহ আলসুলমির এই অভিযানকে আত্মীয়স্বজনরা 'পাগলামি' বলে আখ্যা দিলেও, আব্দুল্লাহ নিজে তা মনে করেন না। স্ন্যাপচ্যাটে নিজের অনুসারীদের জন্য পুরো ভ্রমণের ভিডিওও ধারণ করে রাখছেন আব্দুল্লাহ। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের ফলে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে, সৌদি আরবের কর্মকর্তারা এটিকে 'সকল আরবদের জন্য' একটি মাইল ফলক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
গত সপ্তাহে রিয়াদ থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমের শহর আল-খাসরাহ থেকে আব্দুল্লাহ বলেন, "আমরা এই বিশ্বকাপকে সমর্থন দিতে চাই।"
চওড়া হ্যাট পরে, ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে (যার মধ্যে সৌদি আরব ও কাতারের পতাকা আটকানো) 'সলো ট্রেকিং' চালিয়ে যাওয়া আব্দুল্লাহ বলেন, "আমি নিজেকে একজন কাতারির মতোই মনে করি, যে কিনা আসন্ন বিশ্বকাপ ও এর সফল আয়োজন দেখতে ভীষণ আগ্রহী।"
একসময় কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করার সুবাদে দীর্ঘ ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে আব্দুল্লাহর। কিন্তু অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে আরব উপদ্বীপ পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সেসব ট্রেকিংয়ের তুলনা হয় না।
জানা গেছে, প্রতিদিন সূর্য ওঠার সাথেসাথে হাঁটা শুরু করেন আব্দুল্লাহ এবং সকাল ১০টা অথবা ১০.৩০ মিনিট পর্যন্ত হাঁটেন তিনি। কিন্তু এরপরে তীব্র গরমের কারণে তাকে কয়েক ঘণ্টা বিরতি নিতে হয় এবং আবার বিকালে শুরু করে সূর্য ডোবার আগপর্যন্ত হাঁটেন তিনি।
তবে আব্দুল্লাহ জানান, মাঝেমাঝে তিনি রাতেও হাঁটেন, যাতে করে তার দৈনিক ৩৫ কিলোমিটার হাঁটার রুটিন বজায় থাকে।
নিজের সাথের বোঝা হালকা রাখার জন্য আব্দুল্লাহ শুধু পেট্রোল স্টেশন থেকেই খাবার কিনে খান, বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় ভাত এবং মুরগি দিয়ে খাওয়া সারতে হয় তাকে। আর গোসল এবং কাপড় ধোওয়ার কাজটা তিনি আশেপাশের কোনো মসজিদ থেকে সেরে নেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলো থেকে আব্দুল্লাহ আলসুলমির এই ভ্রমণের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানা যায়: রাতে ঘুমানোর জায়গার অভাব এবং কখনো কখনো তার গায়ের কাছে বিষাক্ত বিছা ঘুরে বেড়াতেও দেখেছেন তিনি!
তাছাড়া, যাত্রাপথে যেসব সৌদি নাগরিকদের সাথে দেখা হচ্ছে তার, তাদের কথাও লিখে রাখছেন আব্দুল্লাহ। এদের কেউ কেউ তাকে উৎসাহ দেন এবং সাথে হালকা জলখাবার ও জুসের বোতল দিয়ে দেন।
আব্দুল্লাহ বলেন, "এই ভ্রমণের মধ্যে অনেক ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা হচ্ছে, কিন্তু যখন আমার বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা হয় তারা আমাকে উৎসাহ দেন, বলেন যে আমার একাউন্টকে তারা অনুসরণ করবেন এবং আমাকে সমর্থন জানাবেন... তখন আমি মনে জোর পাই এবং এই যাত্রাটা শেষ করার অনুপ্রেরণা পাই।
আব্দুল্লাহ জানান, কাতারে পৌঁছানোর জন্য হেঁটে অভিযান শুরুর পর থেকে তিনি সৌদি আরবের এমন অনেক দৃশ্য উপভোগ করেছেন যেগুলো তার আগে কখনোই ভালো লাগতো না।
"জেদ্দা থেকে দোহা পর্যন্ত প্রতি ১০০ কিলোমিটার পথ আলাদা আলাদা! প্রথম ১০০ কি.মি. যদি ধূ ধূ বালুচর হয়, তাহলে এরপরের দৃশ্যে দেখা যাবে পাহাড়পর্বত, তারপর জমি-মাঠ, ক্ষেত", বলেন আব্দুল্লাহ।
আব্দুল্লাহ আলসুলমি মনে করেন, নিজের এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পোস্ট করার মাধ্যমে তিনি অন্য সৌদি নাগরিকদের নিজ দেশে ট্রেকিংয়ের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারবেন।
তিনি বলেন, "আমার এই কাজের মাধ্যমে আমি মানুষকে বোঝাতে চাই যে হাইকিং এবং হাঁটা খুব সুন্দর খেলা। যদিও সৌদি আরবের আবহাওয়া অনুকূল নয়, কিন্তু তাও আমরা চাইলেই এটা সম্ভব। এটা সাধারণ মানুষের খেলা। এর জন্য আপনার দরকার শুধু হাতেগোনা কয়েকটা জিনিস, একটা তাঁবু আর... প্রকৃতি!"
জানা গিয়েছে, সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে আগামী ২২ নভেম্বর আর্জেন্টিনা বিপক্ষে সৌদি আরবের ম্যাচের আগেই দোহায় পৌঁছে যাবেন আব্দুল্লাহ। আর যেহেতু আর্জেন্টিনাও তার প্রিয় দল, তাই দুই পক্ষেই সমর্থন দিতে হবে আব্দুল্লাহর।
এর চারদিন পর পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ রয়েছে গ্রিন ফ্যালকনদের। আর সেই ম্যাচের টিকিটও সংগ্রহ করে ফেলেছেন আব্দুল্লাহ।
নিজের দেশের খেলোয়াড়দের প্রতি সমর্থনের কোনো কমতি নেই আব্দুল্লাহ আলসুলমির। তিনি আপাতত সৌদি আরবের পক্ষেই বাজি ধরেছেন। এযাবত ছয়টি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেছে সৌদি, কিন্তু শুধুমাত্র ১৯৯৪ সালে তারা নকআউট পর্বে যেতে পেরেছে।
কিন্তু আব্দুল্লাহ বলছে, এবছর আমাদের ভালো ভালো খেলোয়াড় আছে। আমাদের কোচ হলেন বিখ্যাত ফরাসি কোচ রেঁনার। আমাদের প্রত্যাশা, এবছর আমাদের দল আকর্ষণীয় পারফরমেন্স দেখাবে!"
সূত্র: আল জাজিরা