মাস্ক পরার দিন ফুরিয়ে এসেছে, তাই ‘হলিউড’ স্টাইলে হাসার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন জাপানিরা!
সাম্প্রতিক সময়ে কিকো কাওয়ানোর একটি ক্লাসে টোকিও আর্ট স্কুলের ডজনখানেকেরও বেশি শিক্ষার্থী নিজেদের মুখের সামনে আয়না ধরে রেখেছিলেন এবং তাদের মুখজুড়ে ছিল প্রশস্ত হাসি। আঙুল দিয়ে মুখের দুই পাশ টেনে ধরে নানাভাবে তারা চর্চা করছিলেন কি করে সুন্দরভাবে হাসা যায়।
হাসি শেখার জন্য পয়সা খরচ করতে অনেকেরই গায়ে লাগবে বটে, কিন্তু জাপানে একজন 'স্মাইল ইনস্ট্রাকটর' হিসেবে কিকো কাওয়ানোর খ্যাতি ও চাহিদা এমনই যে তার ক্লাসে ভর্তি হতে কার্পণ্য করছেন না অনেক জাপানি। করোনাভাইরাস মহামারির প্রাদুর্ভাব কমে আসা এবং জাপানে ধীরে ধীরে মাস্ক পরার বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার কারণে জাপানিরা এখন জনসম্মুখে সুন্দরভাবে হাসার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
কাওয়ানোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন, ২০ বছর বয়সী হিমাওয়ারি ইয়োশিদা জানান, তিনি এই ক্লাস করছেন তাদের স্কুলের কোর্সের একটি অংশ হিসেবে, যেখানে তাদেরকে আসন্ন চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত করে তোলা হচ্ছে। আর সে কারণেই তার নিজের হাসি ঠিক করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
"কোভিডের সময়টায় আমার ফেসিয়াল মাসলের কোনো ব্যবহার হয়নি, তাই এখন এই হাসির চর্চাটা একটা ভালো ব্যায়ামও বটে", বলেন ইয়োশিদা।
কাওয়ানোর কোম্পানির নাম 'ইগাওইকু' যার অর্থ আসলেই 'স্মাইল এডুকেশন' বা হাসির শিক্ষা। গত বছরের তুলনায় এবার তার কোম্পানির চাহিদা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে; কারণ ক্রেতারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এমন বিক্রয়কর্মী দেখতে চান যারা আন্তরিক। সেইসঙ্গে স্থানীয় সরকারগুলোও তাদের বাসিন্দাদের সুস্থতা দেখতে চায়। উল্লেখ্য যে, কাওয়ানোর এক ঘণ্টার একটি হাসির ক্লাস করতে চাইলে গুণতে হবে ৭৭০০ ইয়েন (৫৫ ডলার)।
তবে মহামারির আগেও জাপানের অনেকের কাছেই মাস্ক ব্যবহার করা স্বাভাবিক বিষয় ছিল। জ্বর-ঠাণ্ডার মৌসুমে জীবাণু থেকে দূরে থাকতে কিংবা পরীক্ষার আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করতেন।
কিন্তু চলতি বছরের মার্চেই জাপান সরকার মাস্ক পরার সুপারিশমালা তুলে নিলেও, কিছু মানুষ এখনও প্রতিদিনই মাস্ক পরে বাইরে বের হচ্ছেন। গত মে মাসে পাবলিক ব্রডকাস্টার এনএইচকে'র একটি পোলে দেখা গেছে, ৫৫ শতাংশ জাপানি জানিয়েছে তারা বিগত দুই মাসে প্রায়ই মাস্ক ব্যবহার করেছেন এবং মাত্র ৮ শতাংশ জাপানি জানিয়েছেন যে তারা মাস্ক ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন।
কিকো কাওয়ানোর ক্লাসে অংশ নেওয়া আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থীদের চার ভাগের এক ভাগই তাদের ক্লাসের সময়েও মাস্ক পরা ছিলেন। কাওয়ানোর ভাষ্যে, হয়তো তরুণরা মাস্ক পরা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন; বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে মাস্ক পরা থাকলে আর বাইরে বের হওয়ার আগে মেকআপ করতে হয় না এবং পুরুষেরা শেভ না করলেও তা বোঝা যায় না।
সাবেক রেডিও হোস্ট কাওয়ানো ২০১৭ সাল থেকে হাসির ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি আরও ২৩ জনকে স্মাইলিং কোচ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যাতে করে এই সুঅভ্যাস এবং সুন্দরভাবে হাসার কলা-কৌশল জাপানের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি 'হলিউড স্টাইল স্মাইলিং টেকনিক' নামে একটি পদ্ধতি শেখান শিক্ষার্থীদের, যেখানে 'অর্ধচন্দ্রাকৃতি চোখ', 'গোলাকার গাল' এবং হাসি দিলে উপরের পাটির আটটি দাঁত দেখা যাবে এমনভাবে হাসির চর্চা করা হয়। এই হাসির চর্চা করার ওপর আবার স্কোরও দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের।
কাওয়ানো মনে করেন, একটা দ্বীপ রাষ্ট্র হওয়ায় এবং একক রাষ্ট্র হিসেবে তাদের নিরাপত্তাবোধের কারণেই হয়তো সাংস্কৃতিকভাবেই জাপানিদের পশ্চিমাদের চাইতে হাসির প্রতি ঝোঁক কম।
"সাংস্কৃতিকভাবে, হাসি দিয়ে এই বোঝানো হয় যে আমি তোমার মাথায় কোনো বন্দুক ধরে রাখিনি এবং আমি তোমার জন্য কোনো হুমকি নই", বলেন কাওয়ানো।
জাপানে প্রতিবছরই অসংখ্য পর্যটক বেড়াতে আসেন, তাই এমন পরিস্থিতিতে জাপানিদের উচিত বিদেশিদের সাথে শুধু চোখের দেখার বাইরেও অন্যভাবে আন্তরিক যোগাযোগ তৈরি করা, যোগ করেন তিনি। কাওয়ানোর ভাষ্যে, "আমার মনে হয় মানুষের হাসার অনেক বেশি প্রয়োজন আছে।"