অবশেষে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের আওতায় আনার উদ্যোগ নিল সরকার
বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) সরকার জানিয়েছে, গ্রাহকরা পণ্য বুঝে পাওয়ার আগ পর্যন্ত ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স কোম্পানিগুলো টাকা পাবে না।
গ্রাহক যদি ব্যাংকের ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড অথবা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করেন, সেক্ষেত্রে গ্রাহক যতক্ষণ পণ্য না পাবেন; ততক্ষণ পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ করা তৃতীয় কোনো কোম্পানি টাকা আটকে রাখবে। ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর অর্থ-ব্যবস্থাপনার বিষয়ে এক বহুপক্ষীয় বৈঠকের পর গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বৃহৎ ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালি বিশাল মূল্যছাড়ের প্রলোভন দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছে, কিন্তু যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনের জেরে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ ও দেনার অস্বাভাবিক পার্থক্য বিপুল সংখ্যক গ্রাহককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর ফলে কখনও কখনও ক্রেতারা পণ্য সরবরাহ পাচ্ছেন না এবং বিক্রেতারা পাচ্ছেন না পণ্যের মূল্য।
অনলাইন কেনাকাটার জন্য জন্য প্রণীত এই নতুন নিয়ম সম্ভবত আগামী সপ্তাহের শেষের দিকে কার্যকর হবে।
এদিকে, ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ও ব্র্যাক ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক ইভালিসহ ১০ টি ই-কমার্স সাইট থেকে অনলাইন কেনাকাটার জন্য তাদের কার্ড ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কার্ড লেনদেন বন্ধ হওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—আলেশা মার্ট, ধামাকা, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, কিউকুম, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট এবং নিডস।
ইভ্যালির ওপর করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনটির ওপর ভিত্তি করে গত ২২ জুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনের জের ধরে ই-কমার্সের অর্থ-ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের এই উদ্যোগটি নেওয়া হলো।
মহামারিকালে মানুষ নলাইনে কেনাকাটায় আরও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে এ সময় ই-কমার্সের ব্যবসা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। অনেক বড় ও ছোট উদ্যোক্তা মান বজায় রেখে সময়মতো পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেও সুনাম ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বিশাল মূল্যছাড়ের মূলা ঝুলিয়ে দামের পুরো টাকা অগ্রিম বুঝে নিয়েও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না।
এই খাতটি নিয়ন্ত্রণহীন বলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো সন্দেহজনক ব্যবসায়িক নীতি অব্যাহত রেখেছে। প্রায় এক বছর ধরে খসড়া নির্দেশিকা প্রণয়ন করে বসে আছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন পদ্ধতিতে অর্থ পরিশোধ:
হাফিজুর রহমান জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগামী রবিবার বা সোমবারের মধ্যে নতুন অর্থপ্রদান পদ্ধতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক বলেছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেলেই এই নিয়মটি কার্যকর করা হবে।
বর্তমানে এসএসএল কমার্স, বিকাশ, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও এসএইচবিএলসহ বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পেমেন্ট গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে। তবে ভোক্তাদের কাছ থেকে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর কাছে অর্থ স্থানান্তর করার জন্য কতটা সময় নিতে হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই।
ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ৩-৪ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহকারীদের কাছে অর্থ স্থানান্তর করে।
মেজবাউল বলেন, 'আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবহিত করে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করব, যাতে গ্রাহকদের কাছ থেকে সম্মতি পাওয়ার আগে যেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা পরিশোধ করা না হয়।'
পণ্য বুঝে পাওয়ার গ্রাহকদের পেমেন্ট গেটওয়ে সংস্থার কাছে কোনো টেক্সট মেসেজ পাঠাতে হবে না। ই-কমার্স সাইটগুলোকে গ্রাহকদের স্বাক্ষর করা প্রাপ্তিস্বীকারের রশিদ গেটওয়েতে জমা দিতে হবে।
মেজবাউল হক বলেন, 'যেহেতু তৃতীয়পক্ষের সেবা চালু হতে সময় লাগবে, তাই অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে আমরা এটা চালু করছি।'
তিনি আরও জানান, নতুন অর্থপ্রদান ব্যবস্থা চালু হলেই ব্যাংকগুলো ফের ই-কমার্স সাইটগুলোর সঙ্গে লেনদেন শুরু করবে।
ই-কমার্স কোম্পানিগুলোতে বাড়তি বিনিয়োগের প্রয়োজন:
প্রশ্নবিদ্ধ ডিজিটাল আউটলেটগুলো নতুন গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুরানো গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ করে। সে কারণে যারা ইতিমধ্যে অগ্রিম দাম পরিশোধ করে রেখেছেন, তাদেরকে পণ্য সরবরাহের জন্য কোম্পানিগুলোকে নতুন বিনিয়োগ করতে হবে।
টাকার ব্যবস্থা ওই কোম্পানিগুলোকেই করতে হবে। সময়মতো পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে তাদেরকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ও আইসিটি আইনের আওতায় আনা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির দেনা ১৯০ কোটি টাকা। যেসব গ্রাহক ইতিমধ্যে অর্ডার করে ফেলেছেন, তাদের পণ্যের বাজারমূল্য ২১৪ কোটি টাকা। এই পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করার জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে বিশাল বিনিয়োগ করতে হবে। নইলে ইভ্যালিকে বিক্রেতাদের কাছ থেকে বাকিতে আরও পণ্য নিতে হবে।
নতুন নিয়মে ই-কমার্স কোম্পানি যেহেতু পণ্য সরবরাহের পরে টাকা পাবে, তাই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পণ্য কেনার জন্যও প্রতিষ্ঠানটির বাড়তি বিনিয়োগের দরকার হবে।
অচিরেই হচ্ছে ডিজিটাল বাণিজ্য আইন:
সচিব হাফিজুর রহমান বলেন, অর্ডারের পর ১০ দিনের মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে পণ্য সরবরাহের জন্য আগামী মাসের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি আদেশ জারি করবে।
কোনো অর্ডারের পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে, অর্ডার পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে পণ্য সরবরাহের ব্যর্থতা সম্পর্কে পেমেন্ট গেটওয়েকে জানাতে হবে। পেমেন্ট গেটওয়েগুলো তখন গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেবে।
তবে এখন যেসব অর্ডারের পণ্য সরবরাহের অপেক্ষায় আছে, সেগুলো এই বাধ্যতামূলক ১০ দিনে ডেলিভারি আইনের আওতায় পড়বে কি না, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সভাপতি শমী কায়সার বলেছেন, 'ইতিমধ্যে যেসব গ্রাহক অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেছেন, তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য একটি উপায় বের করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে।'
ডিজিটাল পেমেন্টের ঝুঁকির কারণে আতঙ্কিত ব্যাংক ও এনবিএফআই:
ব্যাংক ছাড়াও লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের মতো নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সাথে লেনদেনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এখনও পর্যন্ত এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কোনো নির্দেশনা দেয়নি।
ব্যাংক-এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা যদি গ্রাহকদের টাকা ফিরিয়ে দিতে না পারে, তাহলে ব্যাংকগুলো ঝামেলায় পড়ে যাবে।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকারস, বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার অবশ্য ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কার্ডে লেনদেনে কোনো ঝুঁকি দেখছেন না। তিনি বলেন, 'নিজের টাকা কোথায় খরচ করবেন, সে সিদ্ধান্ত নেবেন গ্রাহকরাই।'
"এই গ্রাহকই সিদ্ধান্ত নেন যে কোথায় অর্থ ব্যয় করবেন," ইফতেখার, অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাঙ্কারস, বাংলাদেশের চেয়ারম্যানও বলেছিলেন।
বর্তমানে কার্ডের বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশের দখল চারটি ব্যাংকের হাতে। এই ব্যাংকগুলো হলো স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, ইবিএল, ব্র্যাক এবং দ্য সিটি ব্যাংক।
এ বছরের এপ্রিলে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোতে মোট লেনদেন ছিল ৯১১ কোটি টাকা, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।