আমদানির সুতায় ৪ শতাংশ প্রণোদনা চায় বিজিএমইএ
আমদানি করা সুতা ব্যবহার করে উৎপাদিত তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনা চেয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছে আবেদন করেছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমএই)। কাঁচামাল সুতা ও ফেব্রিক আমদানিতে উদ্বুদ্ধ করলে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
তবে সুতা আমদানিতে বিজিএমইএ'র এ প্রস্তাব অনুযায়ী প্রণোদনা দেওয়া হলে দেশের বস্ত্রখাতে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।
বাংলাদেশে উৎপাদিত সুতা ও ফেব্রিক দিয়ে উৎপাদিত তৈরি পোশাক রপ্তানি করলে রপ্তানির বিপরীতে শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয় সরকার।
আমদানি করা সুতা বা ফেব্রিকে উৎপাদিত পোশাক রপ্তানি করলে প্রণোদনা পাওয়া যায় না। দেশে সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় পোশাক মালিকরা বিদেশ থেকে সুতা আমদানিতে আগ্রহী হচ্ছেন। তাই আমদানি করা সুতায় উৎপাদিত তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও একই হারে প্রণোদনা চাচ্ছে বিজিএমইএ।
তবে স্পিনিং মিল মালিকরা বলছেন, আমদানি করা সুতায় প্রণোদনা দেওয়ার অর্থ হলো দেশের জনগণের করের টাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া, যা কোনমতেই কাম্য নয়। এতে দেশীয় স্পিনিং মিল সেক্টর ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমদানি করা সুতায় প্রণোদনা দেওয়ার অর্থ হলো দেশের জনগণের করের টাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া, যা কোনমতেই কাম্য নয়। এতে দেশীয় স্পিনিং মিল সেক্টর ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিটিএমএ-র সাবেক সভাপতি আবদুল হাই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, সুতা থেকে উৎপাদিত তৈরি পোশাকে কোনো প্রণোদনা দেওয়া হলে টেক্সটাইল খাতে বিপর্যয় নামবে, বেকার হয়ে যাবে লাখ লাখ শ্রমিক।
বর্তমানে সরকার শুধু দেশে উৎপাদিত সুতা ব্যবহার করে উৎপাদিত তৈরি পোশাকে ৪ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে।
তবে দেশের বাজারে সুতার দাম বাড়ায় বিদেশি সুতা ব্যবহার বাড়াতে এ প্রস্তাব করেছে বিজিএমইএ। এছাড়া, ম্যান মেইড ফাইবারে উৎপাদিত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১০% হারে প্রণোদনা চেয়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের মালিকদের সংগঠনটি।
এনিয়ে আবদুল হাই বলেন, "গত দুই বছর ধরে শিপিং মিল মালিকরা বিপুল লোকসান দিয়ে সুতা বিক্রি করছেন। এ অবস্থায় যাদের অন্যান্য ব্যবসা ছিল তারাই কোনমতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন তুলার দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে তুলা উৎপাদনের মৌসুমে সুতার দাম কমে আসবে।"
এদিকে গত ১৮ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিতে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান লিখেছেন, বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হলেও এ শিল্প মূলত আমদানি নির্ভর। যদিও বিকল্প নগদ সহায়তা ও সুতা আমদানির ক্ষেত্রে বিধি-বিধানের কারণে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজখাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ হলেও ফাইবার ও সুতার মতো 'কোর' কাঁচামালের আমদানির চাহিদা থেকেই যাবে।
"আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য ও মানের প্রতিযোগী সক্ষমতা, পণ্য বহুমুখীকরণে প্রয়োজনীয় বিশেষ ক্যাটাগরির কাঁচামালের চাহিদা পূরণের সক্ষমতা, সর্বোপরি রপ্তানি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তি চাহিদা পূরণের সক্ষমতার কথা বিবেচনায় কাঁচামাল আমদানি আমাদের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।"
ফারুক হাসান বলেছেন, আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারে বাংলাদেশের দখল মাত্র ৬.৮ শতাংশ, যা দ্বিগুণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন দেশীয় মিলগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে কাঁচামালের অপর্যাপ্ততার কারণে রপ্তানির সুযোগ হাতছাড়া না হয়। সুতা আমদানি উদ্বুদ্ধ করা গেলে কাঁচামালের যোগান বাড়বে এবং ক্রেতারা আরও বেশি ক্রয়াদেশ দিতে উদ্বুদ্ধ হবেন।
সুতা আমদানিতে প্রণোদনা দেওয়া হলে ইউরোপিয় ইউনিয়নে জিএসপি প্লাস বা স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি সুবিধা সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাবে উল্লেখ করে বিজিএমইএ বলেছে, দেশের মোট রপ্তানির ৮১ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে, যার ৭৩ শতাংশই আসে শুল্কমুক্ত সুবিধায়। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর আমাদের এই সুযোগ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
"বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৬২% যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে, যেখানে এভরিথিং বাট আমর্স (ইবিএ) সুবিধার আওতায় সিঙ্গেল ট্রান্সফরমেশন, অর্থাৎ ফেব্রিক থেকে পোশাক তৈরি করলেই শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। ইবিএ সুবিধা হারালে জিএসপি প্লাস বা স্ট্যান্ডার্ড জিএসপি সুবিধা পেলে ডাবল ট্রান্সফরমেশন রুলস অব অরিজিন বা সুতা থেকে ফেব্রিক ও ফেব্রিক থেকে পোশাক তৈরি করতে হবে। এর ফলে পোশাকখাত সংকটের মধ্যে পড়বে"- যোগ করেছে বিজিএমইএ।
বিজিএমইএ বলেছে, আমাদের প্রয়োজনের প্রায় ৮০ শতাংশ সুতা স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত হয়। তাই স্থানীয় পর্যায়ে ফেব্রিক্স উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হলে সুতা আমদানি উদ্বুদ্ধকরণ ও সহজীকরণ প্রয়োজন। তাই দেশীয় সুতা বা বস্ত্রের অতিরিক্ত অন্যান্য উৎস হতে সংগৃহীত সুতা দিয়ে উৎপাদিত সকল প্রকার তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি মূল্যের উপর ৪ শতাংশ হারে বিশেষ নগদ সহায়তা প্রয়োজন।
সংগঠনটি বলেছে, সুতা আমদানিতে ৪ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হলে নিটিং, উইভিং, প্রসেসিং, ব্রাশিং, স্যুয়েডিং, বিলচিং, ডায়িং, প্রিন্টিং, ওয়াশিং ও ফিনিশিং শিল্পে বিনিয়োগ বাড়বে, যা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পরবর্তী বাজার সুবিধা ধরে রাখতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সুতার উপর নির্ভরশীলতায় ভারসাম্য আনতে পারলে পণ্যে বৈচিত্র আনার ক্ষেত্রেও অনেকটা এগিয়ে যেতে পারব। কারণ, আমাদের মিলগুলো মূলত নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির সুতা তৈরি করে। বিশেষায়িত ফেব্রিক্স তৈরি এবং পণ্য বৈচিত্র ও উদ্ভাবনের জন্য আমদানি করা সুতার উপর আমাদের বহুলাংশে নির্ভর করতে হয়।
নন-কটন পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দাবি:
গত ২১ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশির কাছে পৃথক এক চিঠিতে নন-কটন তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনার প্রস্তাব করে বিজিএমইএ বলেছে, এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়বে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, এখাতের রপ্তানি ৩৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও পোশাক পণ্যের উপকরণ বৈচিত্রকরণ হয়নি বললেই চলে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানির ৭৪.১৪ শতাংশই ছিল কটনের তৈরি, যা এক দশক আগে ছিল ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ, এক দশকে পোশাক শিল্পের কটন নির্ভরতা বেড়েছে।
বিজিএমইএ'র তথ্যমতে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ মোট ২০ লাখ ৫২ হাজার টন ফাইবার আমদানি করে, যার ৯৩.৫৭ শতাংশ ছিল কটন। দেশের ৪৩০টি স্পিনিং মিলের মধ্যে ৪০৩টিই কটন স্পিনিং মিল।
"যেখানে বিশ্বের মোট টেক্সটাইল কনজাম্পশনের প্রায় ৭৫ শতাংশই নন-কটন এবং এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ সিনথেটিক (মেন মেইড ফাইবার-এমএমএফ) এবং বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩%-৪ শতাংশ। অন্যদিকে কটনের শেয়ার মাত্র ২৫% এবং বছরে ১%-২% হারে বাড়ছে"- বলেছে সংগঠনটি।
ফারুক হাসান বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নন-কটন পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। ২০১৭ সালে এমএমএফ ভিত্তিক টেক্সটাইল বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের শেয়ার মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ ভিয়েতনামের দখলে ছিল ১০ শতাংশ। অর্থাৎ, বৈশ্বিক ফাইবার চাহিদার বিচারে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কটনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছি।
বিজিএমইএ বলেছে, বিগত দশকে বাংলাদেশে মেন মেইড ফাইবারখাতে কিছু বিনিয়োগ হলেও এগুলো মূলত মূলধন ও প্রযুক্তি নির্ভর। প্রতিযোগী দেশগুলোতে এই শিল্পের কাঁচামাল পেট্রোকেমিক্যাল চিপস থাকায় এবং তাদের স্কেল ইকোনমির কারণে তারা অনেক এগিয়ে আছে।
এই পরিস্থিতিতে নন-কটনখাতে বিনিয়োগ ও রপ্তানি উৎসাহিত করতে এবং প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে নন-কটন পোশাক রপ্তানির উপর ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা প্রয়োজন।