আরএমজি: অর্ডারের পরিমাণ মহামারি পূর্ব সময়ের মাত্রা ছাড়ালেও, দাম বাড়েনি
কোভিড-১৯ মহামারির দেড় বছর কাটানোর পর রপ্তানি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দেশের উভেন পোশাক প্রস্তুতকারকরা। আগামী চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত ১০০ ভাগ কার্যাদেশ পাওয়ার প্রেক্ষিতে এমন আশাবাদ প্রকাশ করেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
তবে কিছু রপ্তানিকারকের অভিযোগ, এখনও অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদেরকে মহামারি পূর্ব সময়ের চাইতেও প্রায় ১০-১৫ শতাংশ কম মূল্য দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। এজন্য রপ্তানিতে সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার অর্জনে আরেকটি মৌসুম লাগতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
নাম না প্রকাশের শর্তে এখাতের একাধিক ব্যবসায়ী নেতা বলেছেন, আরও উচ্চ দাম পেতে এখনই বায়ারদের সঙ্গে দর কষাকষির উপযুক্ত সময়, ন্যায্যমূল্য না দিতে চাইলে উৎপাদকদের উচিৎ তাদের অর্ডার গ্রহণ না করা।
কেউ যদি কম মূল্যে উৎপাদন সক্ষমতার চাইতেও বেশি পরিমাণে অর্ডার পান, তাহলে এক পর্যায়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারবেন না- বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির অন্যতম বাজার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে গত দুই মাসে খচরা বিক্রিবাট্টা কমেছে। তাছাড়া, ভাইরাসের নতুন ধরনের উদ্ভব অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ আগামী মাসগুলোয় ভোক্তাদের মুদি, পরিচর্যা সামগ্রী ও পোশাক ক্রয়ের মতো খাতে অর্থব্যয়কে সংকুচিত করতে পারে বলে আভাস দিয়েছে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, গেল বছর দীর্ঘায়িত শাটডাউনের কবলে পড়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা বিক্রিবাট্টা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এসময় বন্ধ হয়ে যায় পোশাক বিক্রেতা অনেক ব্র্যান্ডের আউটলেট। বাকিরা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে বড় অংকের মূল্যছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। এরপর গত বছরের শেষদিক থেকে বিক্রিবাট্টা বাড়া শুরু করলে ব্যবসা সচলের তাগিদ থেকেই দাম না বাড়িয়ে পণ্য বিক্রি অব্যাহত রাখেন খুচরা বিক্রেতারা।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম বলেন, "এজন্য তারা তখন পুরোনো ইউনিট প্রাইস অফার করেছেন। উৎপাদন খরচ বাড়া সত্ত্বেও তখন আমাদের কাছে কোন বিকল্প ছিল না।"
তিনি জানান, ওই সময়ে পোশাক প্রস্তুতকারকেরাও কার্যাদেশ সংকটে ভুগছিলেন। অনেক কারখানা তাদের উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র ৩০ শতাংশ নিয়ে কারখানা চালু রাখে, একারণে অনেকে তাদের উৎপাদন ইউনিট বন্ধ রাখতেও বাধ্য হয়। অথচ বায়ারদের এজেন্টরা এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের কমিশন মার্জিন বাড়িয়েছিল।
স্প্যারো গ্রুপের এমডি বলেন, "এখন আমরা আগামী গ্রীষ্ম ও বসন্তের (নভেম্বর-মার্চ) জন্য অর্ডার বুক করছি। ইতোমধ্যেই আমরা কোভিড পূর্ব সময়ের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ বেশি দামে সম্পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতার সমান অর্ডার বুক করেছি।"
এক্ষেত্রে পণ্যের দামের ভূমিকা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, উভেন শার্টের গড়মূল্য ৬-৭ ডলার, আর ডেনিম প্যান্টের মূল্য ৭-৮ ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুসারে, বছরওয়ারি হিসাবে গত আগস্টে পোশাক রপ্তানিতে ১১.৫৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এসময় মোট ২৭৫ কোটি ডলারের পোশাক পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
এরমধ্যে, উভেন আইটেমে ৪.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা জুলাইয়ে ১৭.৭৮ শতাংশ কমেছিল।
জুলাইয়ে রপ্তানি ধসের প্রধান কারণ ছিল ঈদুল আজহার ছুটি ও কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে টানা দুই সপ্তাহ কারখানা বন্ধ থাকার ঘটনা।
অবশ্য তার আগে গত বছরের এপ্রিলে সর্বপ্রথম সবচেয়ে কম অঙ্কের বা দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের উভেন পোশাক পণ্য রপ্তানির ঘটনা ঘটে। সে তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলে ১১৮ কোটি ডলারের উভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
গত বছর স্প্যারো গ্রুপ সাড়ে ১৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির এমডি শোভন ইসলাম চলতি বছরের শেষ নাগাদ তা ২০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন।
"আমাদের বর্তমান বায়াররাই নতুন অনেক কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করছেন, নতুন বায়াররাও আসছেন। বায়ারদের মানা করা সহজ নয়, তবে আমাদের ভালো দামও নিশ্চিত করতে হবে।"
কয়েক মাস আগের তুলনায় কিছু বায়ার এখন আরও ভালো দাম অফার করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সম্পূর্ণ বিষয়টি ক্রেতা ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আলোচনার ওপর নির্ভর করে।
এদিকে উভেন খাত ধীরে ধীরে উন্নতি করলেও আগের কার্যাদেশের ব্যাকলগ থাকায় আগস্টের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির প্রতিফলন ঘটেনি।
কারখানা মালিকরা জানান, নভেম্বরের রপ্তানিতে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির প্রতিফলন দেখা যেতে পারে।
দেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, জুলাইয়ে লকডাউন ও ঈদের ছুটির কারণে যেসব কার্যাদেশের চালান জাহাজীকরণ বাকি ছিল, তা আগস্টে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
তিনি বলেন, কারখানাগুলো বিপুল কার্যাদেশ পাওয়ায় আমরা আশা করছি নভেম্বর নাগাদ উভেন পোশাক রপ্তানি ভালো হবে।
ক্লাসিক গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিম বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিটি কারখানা উৎপাদন সক্ষমতার শতভাগ কার্যাদেশ পেয়েছে। তাঁর নিজের কোম্পানিও জানুয়ারি পর্যন্ত অর্ডার পেয়েছে।
তাঁর মতে, মহামারি পূর্ব সময়ের তুলনায় দাম কিছুটা কম পাওয়া গেলেও বিপুল অর্ডারের কারণে তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
এনিয়ে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেছেন, তাঁর কারখানাও সক্ষমতার শতভাগ অর্ডার পেয়েছে, তবে তা ব্যবসা পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট নয়।
উভেন গার্মেন্টস রপ্তানিকারকদের ব্যবসা পুনরুদ্ধারে আরও একটি অনুকূল মৌসুম দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানিকারক অনন্ত অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির জানান, জানুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন সক্ষমতার সম্পূর্ণ অর্ডার পেয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান।
আগামী দিনগুলোয় তিনিও ব্যবসা পুনরুদ্ধারের আশা করছেন।
বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি ও এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবুদ্দিন আহমেদ জানান, এতদিন কারখানা মালিকরা শুধু খরচ উঠে আসার মতো মূল্যে তাদের উৎপাদন ইউনিট পরিচালনা করেছেন। তাই সবাই এখনকার মতো সুদিনের অপেক্ষায় ছিলেন।
দাম নির্ধারণের সময় উৎপাদকদের ব্যবসায়ীক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্রেতারাও ছাড় দেওয়ার উদারতা দেখাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন জ্যেষ্ঠ এ উদ্যোক্তা।