উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কম হাই-টেক পার্কে
দক্ষ জনবল তৈরি, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসা সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সামনে রেখে সারাদেশে ৮টি হাই-টেক পার্ক গড়ে তোলে সরকার। এর মধ্যে ঢাকা বাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ৭টি পার্কের অবস্থা খুবই নাজুক।
এসব পার্ক থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির যে আশা ছিল সরকারের, বাস্তব পরিস্থিতি তার ধারে কাছেও নেই। উদ্যোক্তার অভাবে ঢাকার বাইরের পার্কগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গা। ব্যবসা শুরু করেও হাত গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা।
দক্ষ জনবল তৈরি হাই-টেক পার্কগুলো স্থাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ব্যবসা শুরু করতে না পারা বা শুরুর পর গুটিয়ে নেওয়ার অন্যতম কারণই হচ্ছে দক্ষ জনবলের অভাব। তারা জানিয়েছেন, সাধারণ মানের কাজের জন্য জনবল খানিকটা থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রসর ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল দেশে নেই।
উচ্চ গতির ইন্টারনেট সুবিধাসহ হাই-টেক যেসব সুবিধা থাকার কথা, সেগুলোরও অভাব রয়েছে এসব পার্কে। রয়েছে অবকাঠামোগত নানা দুর্বলতা। উদ্যোক্তাদের দাবি, জেলা পর্যায়ে বেসরকারি স্থাপনার ভাড়ার চেয়ে এসব পার্কের স্পেস ভাড়া ও চার্জ বেশি।
তথ্য প্রযুক্তি খাতের ব্যবসার বেশিরভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক। এ কারণে জেলা পর্যায়ে স্থাপিত পার্কগুলোতে ব্যবসা পরিচালনা লাভজনক নয় বলে জানিয়েছেন এই খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। এসব কারণে ঢাকার কারওয়ানবাজারের জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক বাদে জেলা পর্যায়ের বাকি পার্কগুলোতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
২০১৫ সালে সরকারের ডিজিটাল টাস্কফোর্সের সভায় দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রযুক্তি পার্ক স্থাপন করে পরবর্তী তিন বছরে মোট ১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরের ৫ বছরে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র সাড়ে ৭ হাজার মানুষের।
বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম মনে করেন, তথ্য প্রযুক্তি খাতের দক্ষ জনবল দ্রুত তৈরি হয় না। এ কারণে কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণের বিষয়টি বাস্তবসম্মত ছিল না।
কর্মসংস্থান: লক্ষ্য ১ লাখ, অর্জন মাত্র ৭৫০০
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভায় ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক (এসটিপি), ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
কিন্তু পাঁচ বছর শেষে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র সাড়ে ৭ হাজার মানুষের। এর মধ্যে কালিয়াকৈর হাই-টেক পার্কের ৪ হাজার ২৯৬ জনের কর্মসংস্থানও রয়েছে। কালিয়াকৈর পার্ক পরে আলাদাভাবে এক লাখ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল।
কর্মসংস্থানের এই করুণ অবস্থার কারণ জানতে চাইলে হোসনে আরা বেগম বলেন, কোনো সমীক্ষা ছাড়াই কর্মসংস্থান সৃষ্টির এই বিশাল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রযুক্তি খাতে রাতারাতি কর্মসংস্থান হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। এ রকম জনবল তৈরি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
তিনি জানান, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে সারাদেশে তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এক লাখ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আশাবাদী তিনি।
উদ্যোক্তার অভাবে খালি ৫৯ শতাংশ স্পেস
২০১০ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদশে হাইটেক পার্ক অথরিটির (বিএইচটিপিএ) আওতায় দেশে এ পর্যন্ত মোট ৮টি পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: ঢাকার জনতা টাওয়ার, কালিয়াকৈরের বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক, যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, সিলেট ও রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক, চট্টগ্রামে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, বরিশাল ও মাগুরায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার।
এসব পার্কে বিএইচটিপিএ মোট ১৩.১৫ লাখ বর্গফুট স্পেস ডেভেলপ করেছে। কিন্তু ভাড়া হয়েছে মাত্র ৫.৪১ লাখ বর্গফুট। অর্থাৎ ডেভেলপ করা স্পেসের প্রায় ৫৯ ভাগই এখনো খালি পড়ে রয়েছে।
শুধু গত অর্থবছরেই পার্কগুলোতে ৩.৬০ লাখ বর্গফুট স্পেস ডেভেলপ করা হয়েছিল। ভাড়া হয়েছে মাত্র ১.৭০ লাখ বর্গফুট। ৫৩ শতাংশ স্পেসই এখনো ফাঁকা।
চলতি অর্থবছরে ২.৮ লাখ বর্গফুট স্পেস ডেভেলপের লক্ষ্য আছে বিএইচটিপিএ'র। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ভাড়া হয়েছে মাত্র ২ হাজার বর্গফুট।
প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তার অভাবেই ডেভেলপ করা স্পেস খালি পড়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কিছু পার্কে স্পেস ভাড়া নিয়েও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় উদ্যোক্তারা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।
উদ্যোক্তার অভাবে হাই-টেক পার্কগুলোতে বিপুল পরিমাণ স্পেস খালি পড়ে রয়েছে, এমনটা মানতে নারাজ বিএইচটিপিএ'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম। তিনি বলেন, 'স্পেস বরাদ্দ পেতে অনেক আবেদন আসছে আমাদের কাছে। ভবিষ্যতে স্পেসের ভাড়া বাড়তে পারে, এই আশঙ্কায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের বাইরেও অনেকে আবেদন করছেন।'
তিনি জানান, স্পেস বরাদ্দ পেয়েও অনেকে ব্যবসা শুরু করতে পারেননি। এ কারণে স্পেস বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএইচটিপিএ এখন সতকর্তার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে।
অতিরিক্ত ভাড়ায় বিমুখ উদ্যোক্তারা
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, প্রযুক্তি পার্কগুলোর ভাড়া বেশি। অতিরিক্ত ভাড়ার কারণেই প্রচুর স্পেস খালি পড়ে রয়েছে। তারা জানান, রাজধানীর জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে সার্ভিস চার্জসহ প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ৩৫ টাকা। কিন্তু কালিয়াকৈরে এই ভাড়া ৩০ থেকে ৫০ টাকা, যা ঢাকার চেয়েও বেশি।
যশোরের টেকনোলজি পার্কের ভাড়া প্রতি বর্গফুট ১৪ টাকা, যা যশোরের অন্যান্য কমার্শিয়াল স্পেসের ভাড়ার চেয়ে বেশি। সিলেটের কোম্পানিগঞ্জে স্থাপিত পার্কে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ১১ টাকা, যা সেখানকার অন্যান্য বাণিজ্যিক স্পেসের ভাড়ার তুলনায় বেশি।
যশোরে ১.৪৫ লাখ বর্গফুট স্পেসের মধ্যে ভাড়া হয়েছে ১.১৭ লাখ বর্গফুট। সিলেটের ১৬২ একর জমির পুরো স্পেসই ফাঁকা পড়ে রয়েছে। রাজশাহীর পার্কের ১০টি ভবনের মধ্যে ভাড়া হয়েছে মাত্র একটি।
বরিশাল ও মাগুরার শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার দুটিতে গড়ে ২৭ হাজার বর্গফুটের স্পেস ডেভেলপ করা হয়েছে। কিন্তু উদ্যোক্তার অভাবে পুরোটাই পড়ে আছে খালি।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ১.২০ লাখ বর্গফুট জায়গা খালি পড়ে রয়েছে।
ভাড়া বেশি- এ কথাও মানতে নারাজ হোসনে আরা বেগম। তিনি বলেন, জমির দাম, উন্নয়ন ব্যয় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার বেসরকারি ভবনগুলোর ভাড়ার সঙ্গে তুলনা করেই হাইটেক পার্কগুলোতে স্পেস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, অভাব দক্ষ জনবলের
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, শুধু বেশি ভাড়াই নয়, বেশিরভাগ পার্কেই নেই প্রয়োজনীয় হাই-টেক অবকাঠামো। উচ্চ গতির ইন্টারনেট একটি বড় সমস্যা বলে তারা জানিয়েছেন। অনেক পার্কে নেই ব্যাংকিং লেনদেনের সুবিধাও। পার্কগুলোতে প্রবেশ-প্রস্থানের হাজিরা, স্পেস ভাড়া ও অন্যান্য সার্ভিস চার্জ লেনদেন করতে হয় কাগজে-কলমে।
সবচেয়ে বড় অভাব দক্ষ জনবলের। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গেমিং, ইন্টারনেট অব থিংগস (আইওটি), মেশিন লার্নিং, বিগ ডাটা প্রসেসিং, ক্লাউড কম্পিউটিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেইন প্রযুক্তির মতো অগ্রসর খাতগুলো নিয়ে কাজ করার মতো জনশক্তির সংকট সীমাহীন বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তরা।
ঢাকার বাইরের পার্কগুলোতে সামান্য যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে, এর বেশিরভাগই সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ওয়েবসাইট ডিজাইন, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো তথ্যপ্রযুক্তির মামুলি কাজে জড়িত।
সরকারের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি মূল্যায়ন
সারা দেশে গড়ে তোলা হাই-টেক পার্কগুলোর দুরাবস্থার প্রতিনিধিত্বমূলক একটি চিত্র পাওয়া যেতে পারে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের অবস্থা থেকে। এই পার্ক নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বমানের অবকাঠামো ও দক্ষ জনশক্তির অভাব, ব্যাংকিং ব্যবস্থা না থাকা, বেশি স্পেস ভাড়া ও বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি বিলের চাপে একটি জাপানি ও একটি দেশি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই যশোর পার্ক থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। বকেয়া বিল আর লোকসানের চাপে কোণঠাসা বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও।
পার্কে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে আইএমইডি বলেছে, দক্ষ জনশক্তির অভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে কাজ নিতে পারছে না স্থানীয় ফার্মগুলো। ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, জাপান ও ইউরোপের ফার্মগুলোর ছেড়ে দেওয়া কম মূল্যের কাজগুলো করে এখানকার ফার্মগুলো কোনোভাবে টিকে রয়েছে।
এ পার্কের মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার উন্নয়নের কাজ করতে পারে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ওয়েবসাইট ডিজাইন ও ই-কমার্সের মতো সাধারণ মানের কাজ করে।
এই পার্কে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ৭০০ জনের।
হাইটেক পার্কের সাফল্য নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়ার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিডি জবস ডট কমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, দেশের অধিকাংশ আইটি প্রতিষ্ঠান আকারে ছোট। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে ১০ থেকে ৫০ জন কর্মী কাজ করেন। ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাটেই এমন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব। এসব প্রতিষ্ঠান রাজধানী ছেড়ে কোথাও যেতে চাইবে না। এই কারণে প্রযুক্তি পার্কগুলোও কার্যকর হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আইটি খাতের গ্রাহক প্রতিষ্ঠানগুলোও ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে আইটি ফার্মের উৎপাদিত পণ্য ও সেবা বিক্রি করা সহজ। এ অবস্থায় বিনামূল্যে জমি দেওয়া হলেও কোনো প্রতিষ্ঠান যশোর, সিলেট, চট্টগ্রাম বা রাজশাহী যেতে চাইবে না।
প্রযুক্তি পার্কগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা আশাবাদী বেসিসের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবীর। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, এসব পার্ক নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের সব কিছু এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে ব্যবসা নিয়ে যাওয়ার মতো অবকাঠামো এতদিন ছিল না। এখন অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।'