একক মাস হিসাবে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের রেকর্ড সেপ্টেম্বরে
সবচেয়ে বেশি পোশাক পণ্য জাহাজীকরণের সুবাদে, গত সেপ্টেম্বরে একক মাস হিসাবে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। এসময় মোট ৪১৬ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে।
বছরওয়ারি হিসাবে যা গত বছরের সেপ্টেম্বরে হওয়া ৩.০১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৩৭.৯৯ শতাংশ বেশি। সোমবার (৪ অক্টোবর) রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্যসূত্রে এসব কথা জানা গেছে।
রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিগুলোর পুনঃউন্মুক্তকরণের ফলে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধিই এর পেছনে অবদান রেখেছে।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "অর্থনীতিগুলো পুনরায় সচল হতে শুরু করায় ক্রেতাদের অব্যাহত চাহিদা পূরণে খুচরা বিক্রেতাদের বাল্ক আকারে পণ্য দরকার। এজন্য তারা বড় অর্ডার দিচ্ছে। প্রায় দুই বছর ধরে মানুষ নির্বিঘ্নে ঘরের বাইরে বেরোতে পারেনি, চলাফেরার বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার কারণে তারা অনেক বেশি কেনাকাটাও করছে।"
"হঠাৎ করে বিপুল কার্যাদেশ পাওয়ায় অনেক সরবরাহকারী ভাড়া করা বিমানে পণ্য পাঠিয়েছেন, যা বাংলাদেশের এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের তথ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল সরবরাহকারীরাও প্রভাবিত হয়েছেন, ফলে সরবরাহ চক্রে বিচ্ছিন্নতা ও পণ্য পরিবহনের সংকট তীব্রতা লাভ করেছে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ প্রতিমাসে গড়ে ৩০০ কোটি ডলারের রপ্তানি করলেও, এখন সে সংখ্যা ৪০০ কোটিতে পৌঁছে গেছে। তবে রপ্তানিকারকদের বাড়তি আয় কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশি উৎপাদকদের পণ্য বৈচিত্র্যকরণের পাশাপাশি, কম দামে কার্যাদেশ না নেওয়ার ওপরও গুরুত্ব দেন ড. মোয়াজ্জেম।
গত মাসের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯৯ কোটি ডলার, যার চেয়ে ৩৯.১৭ শতাংশ বেশি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম প্রান্তিকে বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ মোট ১১.০২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করেছে, যা গত অর্থবছরের একই মেয়াদের তুলনায় ১১.৩৭ শতাংশ বেশি। গেল বছর এসময়ে ৯৮৯ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়।
ইপিবি'র তথ্যানুসারে, প্রান্তিকওয়ারি আয়ও লক্ষ্যমাত্রার ১০.৪৩ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ৫.৬৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানিও ৪১.৬৬ শতাংশ বাড়ে।
সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে নিট পোশাক রপ্তানিতে, বছরওয়ারি হিসাবে যা গেল বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১.২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মুখ দেখে।
উভেন পোশাক রপ্তানিতেও ৪২.১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত মাসে নিটওয়্যার ও উভেন রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৯০ ও ১৫১ কোটি ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই- সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পোশাক খাত মোট ৯.০৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করেছে, বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধির হিসাবে যা ১১.৪৮ শতাংশ।
পোশাকের মতো চামড়া রপ্তানিও ৩৭.২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, সেপ্টেম্বরে মোট ৯৬.৬৩ মিলিয়ন ডলারের চামড়া রপ্তানি হয়, প্রথম প্রান্তিকের পুরো সময়ে অর্জিত প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশের বেশি।
গত মাসে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে প্রায় ১৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার উপার্জন করেছে বাংলাদেশ, গত বছরের একই মেয়াদের তুলনায় যা ৪৭.২৮ শতাংশ বেশি। হিমায়িত ও জ্যান্ত মাছ রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩.৩১ শতাংশ বা ৬৪.৬৩ মিলিয়ন ডলার। আর হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিতে ১০৪.১৭ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়।
এছাড়া, গত মাসে ওষুধ ও প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিতে যথাক্রমে ২৯.১৮ ও ১০.৮৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আসে।
কিন্তু, গেল অর্থবছরে শত কোটি ডলার রপ্তানি আয় অর্জনকারী পাট ও পাটজাত পণ্য খাত ২৪.৫৫ শতাংশ পিছিয়ে পড়েছে। এ খাত থেকে ২১ কোটি ডলার রপ্তানি আয় এসেছে।
দেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ'র একজন পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, "রপ্তানিতে পুনরুদ্ধার হওয়াটা খুবই দরকার ছিল, কোভিড পরিস্থিতির উন্নতির ফলে বিশ্বব্যাপী পোশাক পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে দেশের পোশাক খাতের আয় বৃদ্ধিতেও তারই প্রতিফলন দেখা যায়। তবে পরিবহন খরচ ও সুতার মূল্য বৃদ্ধি কিছুটা হলেও রপ্তানি আয়কে স্ফীত করেছে।"
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল্লাহ হিল রাকিব অবশ্য রপ্তানির অঙ্ক বৃদ্ধিকে পরিস্থিতি উদ্ভূত বলে মনে করছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী নাও হতে পারে। তবে তিনি এ খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে স্বীকার করে একে সুসংবাদ বলে অবিহিত করেন।
তার মতে, পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত তুলা ও রাসায়নিকের মতো কাঁচামালের উচ্চমূল্যের প্রভাব রপ্তানি আয়ে প্রতিফলিত হয়েছে, তবে খরচ বাড়া সত্ত্বেও কিছু বিদেশি ক্রেতা কম মূল্য দিতে চাইছেন।
বিজিএমইএ'র অন্যতম পরিচালক রাকিব জানান, "সংগঠন হিসেবে আমরা পোশাক প্রস্তুতকারকদের ন্যায্য মূল্য নিয়ে দর কষাকষির অনুরোধ করেছি।"
বিশ্বজুড়ে টিকাদানে গতি আসায় মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে এবং তার ফলে ক্রেতারাও মহামারি পূর্ববর্তী সময়ের মতো কেনাকাটা শুরু করেছেন বলেও জানান তিনি।
টিপ গ্রুপের এমডি বলেন, এখনও অনেকস্থানে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা থাকায় মানুষ বিনোদনের বাজেট পোশাক কিনতে খরচ করছে, যার ফলে খুচরা বিক্রেতারা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন।
"খুচরা বিপণীগুলো পুনরায় খুলেছে এবং অনলাইন শপগুলোও ভালো ব্যবসা করছে। গ্রাহকদের দ্রুত কেনাকাটার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের বায়াররাও দ্রুত পণ্যের চালান পাঠানোর তাগাদা দিচ্ছেন। গত বছরে কেনা তাদের নিজস্ব মজুদও প্রায় নিঃশেষিত হওয়ার কারণেও এখন বাড়তি অর্ডার দিচ্ছেন।"
রাকিবের সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মহামারির কারণে চামড়াজাত পণ্যের খুচরা মূল্য প্রায় ৬০ শতাংশ কমে যায়, যা এখন আগের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ছে, তবে আগের দরে কেনা কাঁচামালের মজুদ থাকায় চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতার সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ।