ওয়ান ব্যাংক: কর্মচারীদের বেতন কর্তন, মালিকদের জন্য উচ্চহারে ডিভিডেন্ট ঘোষণা
কর্মচারী ও মালিকদের প্রতি আচরণের দিক দিয়ে সম্প্রতিই ২২ বছরে পা দেওয়া ওয়ান ব্যাংককে অনন্যই বলা চলে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ব্যাংকটি কর্মচারীদের বেতন কমালেও, গত বছর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েও পরিচালকদের ডিভিডেন্ট কমায়নি।
ঋণ গ্রহীতাদের জন্য পেমেন্ট ডিফারেল সুবিধা উঠিয়ে নেওয়ার পরবর্তী সময়ে খেলাপি ঋণ এড়াতে যে সময়ে ব্যাংকগুলোর উচ্চ প্রভিশন বজায় রাখা প্রয়োজন, ঠিক সে সময় এর একেবারে বিপরীত পথে হাঁটছে ব্যাংকটি।
প্রভিশন ঘাটতি থাকা সত্বেও ২০২০ সালে এর আগের বছরের চেয়ে বেশি পরিমাণ ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে ব্যাংকটি।
গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামো শক্তিশালী করতে নগদ বিতরণে নিরুৎসাহিত করছিল, তখনও ব্যাংকটি এর আগের বছরের তুলনায় অধিক পরিমাণে ক্যাশ ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ওয়ান ব্যাংক ৬ শতাংশ নগদ ও ৫.৫ শতাংশ স্টকসহ ১১.৫ শতাংশ ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে। যেখানে ২০১৯ সালে ব্যাংকটির ঘোষিত ডিভিডেন্ট ছিল ১০ শতাংশ, ক্যাশ ও স্টক ডিভিডেন্ট ছিল ৫ শতাংশ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি ছাড়াই ব্যাংকটি ডিভিডেন্ট ঘোষণা করে। অর্থাৎ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যু করা ডিভিডেন্ট নীতিমালা না মেনেই এ সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংকটি, জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটির রিটেইনড আয় থেকে সমন্বয়য় করে নেয়, ফলে ব্যাংকটির রিটেইন্ড আয়েও বিপর্যয় দেখা দেয়। সামনের দিনগুলোতে বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় রিটেইনড আয় শক্তিশালী রাখাও অপরিহার্য বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা।
ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফখরুল আলমের সঙ্গে ফোন কলে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ক্ষুদেবার্তারও উত্তর দেননি তিনি।
১৯৯৯ সালের ১৪ জুলাই ব্যাংকটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়, আজ বুধবারই ব্যাংকটির ২২ বছর পূর্তি। ২২ বছরে দাঁড়িয়েও ব্যাংকটির গত বছরে নেট লাভে ২১ শতাংশ কমে আসে।
ব্যাংকটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের শেষে ব্যাংকটির নেট লাভ ছিল ১৩১.৩ কোটি টাকা, এর আগের বছরও এই পরিমাণ ছিল ১৬৬ কোটি টাকা।
লাভ কমে আসায় এর প্রভাব পড়ে কর্মচারীদের বেতনের ওপর, গত বছর তাদের ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন কাটা হয়। এখন পর্যন্ত কর্মচারীদের ১০-২০ শতাংশ কম বেতন দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকটি যখন মালিকদের উচ্চ ডিভিডেন্ট দিচ্ছিল, মহামারির সেই সময়েই কর্মচারীদের ইনসেনটিভ বোনাস আটকে রাখা হয়, এমনকি পদোন্নতিও স্থগিত রাখা হয়।
ফলস্বরূপ, ব্যাংকটির অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাই চাকরি ছেড়ে চলে যান, ফলে দেখা দেয় লোকবল সংকট।
কোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অন্যতম নির্দেশক হলো সেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। এ বছরের মার্চ মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৯ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে এ পরিমাণ পঞ্চম অবস্থানে আছে।
এছাড়াও, ব্যাংকের বোর্ডে সুশাসনের অভাবে ব্যাংকটির আর্থিক সূচকেরও অবনতি ঘটছে।
গত বছরের জুলাইতে ঋণ খেলাপের দায়ে সাঈদ হোসেন চৌধুরীকে ওয়ান ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তিনি তার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করলেও তাকে পুনরায় চেয়ারম্যান পদে বসার অনুমতি দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এছাড়া, ব্যাংকটির বোর্ডে বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ রোধে গত বছরের নভেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকটিতে একজন পর্যবেক্ষক নিযুক্ত করে।
সাঈদ হোসেন চৌধুরী এইচআরসি গ্রুপেরও চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০১৯ সালের ১৬ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত নতুন শিথিল নীতিমালার আওতায় তার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করা হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাংকটির স্টকের মূল্যেও এর আর্থিক দৈন্য দশার প্রতিফলন দেখা যায়।
উচ্চ ডিভিডেন্ট ঘোষণা সত্বেও ব্যাংকটির প্রতি শেয়ারের অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) বর্তমানে ১০ টাকা।
ডিএসই'র তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ব্যাংকটির প্রতি শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে ৮ টাকা থেকে ১৫ টাকার মধ্যে।