কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংকটে ফিড শিল্প
করোনা সংক্রমণের তীব্রতা কমে আসায় আস্তে আস্তে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও নতুন করে সংকটে পড়েছে দেশের ফিড কোম্পানিগুলো। স্থানীয় ও আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে এ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি ফিড মিল মালিকদের।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার চেয়েও খারাপ সময় পার করছেন তারা। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারে কাঁচামালের দর বেড়েছে গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি। আমদানি করা কাঁচামালের দাম তো বেড়েছেই, সেইসঙ্গে বেড়েছে ফ্রেইট খরচও।
কিন্তু ফিড মিল মালিকরা ক্রমবর্ধমান খরচের এই বোঝা ভোক্তাদের কাঁধে চাপাতে পারছেন না। ফলে বেড়ে যাচ্ছে তাদের উৎপাদন খরচ।
অথচ পণ্যের দাম বাড়ানো সম্ভব হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। ফলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এর জেরে এ খাতে উৎপাদন ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমে গেছে বলে দাবি তাদের।
আলেয়া ফিডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার মনসুর হোসেন বলেন, 'করোনার পর দেশের অর্থনীতি পুনরায় চালু হলেও ফিড শিল্প খারাপ সময় পার করছে। বিশেষ করে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির ফলে অনেকসময় উৎপাদিত পণ্য লোকসানে বিক্রি করা লাগছে।'
অনেক সময় কেজিতে ৫ টাকাও লোকসান দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হয়েছে তাদের। এর বিপরীতে উদ্যোক্তারা পণ্যের দাম সেই হারে বাড়াতে পারেননি। ফলে অনেকেরই বড় লোকসান হচ্ছে।
মনসুর হোসেন আরও বলেন, 'বছরের এই সময়টাতে আমরা ২২ টাকা কেজি দরে ভুট্টা কিনতাম; এখন ৩০ থেকে ৩১ টাকার বেশি দরে কিনতে হচ্ছে।' পোলট্রি ফিডে প্রায় ৫৫ শতাংশ ভুট্টা ব্যবহৃত হয়।
একসময় যে ভুট্টা ৮০ ডলারে বিক্রি হতো, তা এখন ৩৩০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান মনসুর হোসেন। অথচ উদ্যোক্তাদের ৪০ শতাংশ কাঁচামাল এখনও আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আহসানুজ্জামান বলেন, 'কাঁচামালের দরবৃদ্ধির ফলে মিল মালিক ও প্রান্তিক খামারিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।'
যে হারে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, প্রান্তিক খামারিদের স্বার্থ বিবেচনা করে মিল মালিকরা সেই হারে ফিডের দাম বাড়াতে পারছেন না। আবার বাকিতে ফিড বিক্রি করার কারণে টাকা আটকে যাচ্ছে কোম্পানিগুলোর।
তবে মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা অনেক বেশি দর বাড়িয়ে মুনাফা করছে বলে মন্তব্য করেন আহসানুজ্জামান।
তিনি বলেন, 'যে সময়টাতে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, তখনই কাঁচামালের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি খাতটিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।'
টিকে থাকার জন্য সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার ওপর ধার্য করা ১৫ শতাংশ কর ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানান আহসানুজ্জামান।
প্রান্তিক খামারিরা পোলট্রির জন্য প্রায় ৮০ শতাংশ, গরুর জন্য ৫ থেকে ১০ শতাংশ এবং মাছের জন্য ৫০ শতাংশ ফিনিশড ফিড কেনেন। দেশে এখন ফিডের বার্ষিক চাহিদা ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন, যার ৯৯ শতাংশ স্থানীয় কোম্পানি উৎপাদন করছে।
তবে এখনও চিংড়ি মাছের জন্য কিছু ফিড আমদানি হচ্ছে বলে জানান আহসানুজ্জামান।
তালিকাভুক্ত ফিড উৎপাদকদের পারফরম্যান্স
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানি—আমান ফিড মিলস, ইনডেক্স-এগ্রো লিমিটেড ও ন্যাশনাল ফিড মিলস—মিশ্র পারফরম্যান্স দেখিয়েছে।
আমান ফিড মিলসের মুনাফা কিছুটা বাড়লেও কমেছে অন্য দুই প্রতিষ্ঠানের। ইনডেক্স এগ্রো লিমিটেডের বিক্রি কমেছে ৫ শতাংশের বেশি। sআর ন্যাশনাল ফিড মিলসের বিক্রি কমেছে ৪০ শতাংশ।
ইনডেক্স এগ্রোৎ সচিব আবু জাফর আলী বলেন, 'মহামারির পর আমরা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছি। তবে কাঁচামালের দরবৃদ্ধি এ খাতকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।'
ফিড শিল্পের অবস্থা
পোলট্রি ফার্মিং এর পাশাপাশি মাছ ও গবাদি পশু চাষ বৃদ্ধির কারণে গত এক দশকে ফিড শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
এছাড়া হোটেল ও রেস্তোরাঁ শিল্পের প্রসারের ফলে পোলট্রি শিল্পও লাভবান হয়েছে। হোটেল রেস্তোরাঁর খাবারের মেন্যুতে মুরগি একটি প্রচলিত খাদ্য হওয়ায় এর চাহিদাও অনেক। এর ফলে ফিড উৎপাদন বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
বর্তমানে পোলট্রি খাতের বিনিয়োগ প্রায় ৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। আগামী দশকে সংখ্যাটি দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া, পোলট্রি খামারের সংখ্যা বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ করে বাড়ছে।
এদিকে, দুগ্ধ খাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। দুগ্ধের বার্ষিক বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। ২০২৯ সালের মধ্যে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দেশের। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একটি জরিপে দেখা যায়, বর্তমানের প্রায় এক কোটি টন দুগ্ধের উৎপাদন সে সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ হবে।
পোলট্রি, গবাদি পশু ও মাছ—এই তিন প্রধান উপখাতে সরবরাহ করে ফিড শিল্প। গত কয়েক বছরে এই তিন শিল্পের আয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশে পশুখাদ্যের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ টন।
নুরিশ পোলট্রি ফিড, এসিআই, কাজী ফার্মস, প্রোভিটা ফিড, আফতাব ফিড, নিউ হোপ ফিড ও আমান ফিড বর্তমানে এই বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি অংশীদারিত্বে রয়েছে।
পাশাপাশি ইউনাইটেড ফিড, সিটি পোলট্রি, সিপি বাংলাদেশ, আরআরপি এগ্রো, কোয়ালিটি ফিডস, এআইটি ফিডস ও এজি এগ্রো ফিড বাজারের উল্লেখযোগ্য কোম্পানি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনগুলোর শীর্ষ সংস্থা বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল-এর (বিপিআইসিসি) তথ্যানুসারে, দেশে নিবন্ধিত ফিড মিলের সংখ্যা ২৬১। এর মধ্যে ১৩৫ থেকে ১৪০টি সংস্থা প্রাণিসম্পদ পরিষেবা বিভাগ থেকে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে। এছাড়া দেশে অনিবন্ধিত ফিড মিল আছে আরও দুই শতাধিক।