খাতুনগঞ্জে প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে পেঁয়াজের দাম, একদিনেই দ্বিগুণ
দেশের সর্ববৃহৎ ভোগ্য পণ্যের পাইকারী বাজার খাতুনগঞ্জে সোমবার সকালে পেঁয়াজের দাম ছিল কেজি প্রতি ৩৫ টাকা। ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পরই রাত পর্যন্ত ক্রমাগত দাম বেড়ে বিক্রি হয় ৫০ টাকায়।
মঙ্গলবার সকাল থেকে আবারও প্রতি ঘণ্টায় বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। দুপুর ১টা পর্যন্ত কেজিপ্রতি দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ টাকা।
এদিকে, চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পেঁয়াজ কিনতে আসা খুচরা ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের কাছে রীতিমতো অসহায় পড়ে পড়েছেন। বেশি দামে পেঁয়াজ কিনে খুচরা পর্যায়ে গ্রাহকদের কাছে কত টাকায় বিক্রি করতে পারবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তাদের।
অন্যদিকে, আড়তদাররা বলছেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম নগরীর ফ্রি পোর্ট এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী আবু সাঈদ বলেন, 'আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকে কয়েকটি আড়তদারের কাছে গিয়েছি। কেজিপ্রতি ৭০ টাকার নিচে পেঁয়াজ বিক্রি রাজি হচ্ছেন না। আমি সোমবার সকালে কেজিপ্রতি ৩৮ টাকা দরে পেঁয়াজ কিনেছি। একদিনের ব্যবধানে পাইকারী বাজারে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অথচ আড়তদারদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ রয়েছে। ৭০ টাকায় কেজি দরে পেঁয়াজ কিনলে আমরা খুচরা পর্যায়ে কত টাকায় বিক্রি করব?'
মঙ্গলবার সকালে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়ত ঘুরে দেখা যায়, খুচরা ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কেনার জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন। অনেক আড়তদারই পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। যে কয়েকটি আড়তে বিক্রি হচ্ছে, তাও ক্রেতাদের চাহিদার তুলনায় নগণ্য।
দুপুর ১টায় পেঁয়াজের আড়ত কামাল উদ্দিন ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপক মোঃ নাছির উদ্দিন বলেন, 'আজ (মঙ্গলবার) সকালে কেজি প্রতি পেঁয়াজ ৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। পেঁয়াজের দাম এখন আরও বেশি। এই মুহূর্তে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রেখেছি।'
পেঁয়াজের মজুদ থাকা স্বত্বেও কেন বিক্রি বন্ধ রেখেছেন- এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।
আরেক আড়তদার, বেঙ্গল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ছাবের আহমদ বলেন, 'পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন আমদানিকারকরা। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা খাতুনগঞ্জে দাম বৃদ্ধি করেছেন। এক্ষেত্রে আড়তদার হিসেবে আমাদের কিছু করার নেই।'
খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের পাইকারী বাজার ঘুরে দেখা যায়, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় পেঁয়াজভর্তি ট্রাকের সংখ্যা কম। তবে পেঁয়াজ কিনতে আসা খুচরা ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি। প্রায় প্রতিটি আড়তে খুচরা ব্যবসায়ীদের দর কষাকষি করতে দেখা গেছে। চাহিদামতো কিনতে না পেরে খুচরা ব্যবসায়ীরা এই সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তারা অভিযোগ করেন, আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাজার স্বাভাবিক রাখতে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান তারা।
হামিদ উল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত তিনদিন ধরে বাজারে পেঁয়াজের ক্রেতা তেমন ছিলেন না। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ায় মঙ্গলবার সকাল থেকে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫ গুণ বেশি ক্রেতা ভিড় করছেন। যোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় দাম বেড়ে গেছে।' তবে এই অবস্থা বেশি দিন স্থায়ী হবে না বলে জানান তিনি।
ভারত থেকে চার মাস পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ চান ব্যবসায়ীরা
২০১৯ সালের এই সময়ে ভারত রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যবসায়ীরা সমুদ্র ও আকাশ পথে পেঁয়াজ আমদানি করেন। পুনরায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করায় অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিকারকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি না হওয়ার জন্য সরকারের কাছে আগামী চার মাস ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধের নির্দেশনা চান তারা।
মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, 'প্রতি টন ৪০০ থেকে ৫০০ ইউএস ডলারে চীন, মিয়ানমার, তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা যায়। এসব দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। এই সময়ে ভারত থেকে পুনরায় পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে আমদানিকারকেরা আবারও লোকসানে পড়বেন। তাই আগামী চার মাস ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রাখা হলে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে বাজার স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে।'
সমুদ্র পথে আমদানি অনুমতির আবেদন বেড়েছে
এদিকে, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করায় সমুদ্র পথে পেঁয়াজ আমদানির আবেদন বেড়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে আমদানিকারকেরা চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রে (প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশন) পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পেতে আবেদন করছেন।
প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশনের উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান বুলবুল বলেন, '১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীন, মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, পাকিস্তান থেকে সমুদ্র পথে ৫৪ জনকে ১৯ হাজার ৮৪৩ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্ল্যান কোয়ারেন্টিন স্টেশন। এর মধ্যে শুধু মঙ্গলবারই ২১ জন আমদানিকারককে ১০ হাজার ৭৪২ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়।'
'চলতি অর্থবছরের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে পেঁয়াজ ছাড় হয় ১০৮২ মেট্রিক টন,' বলেন তিনি।
গত বছর সমুদ্র পথে বেড়েছিল আমদানি
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মেটাতে সড়ক পথে ভারত থেকে আমদানি বেশি হলেও গত বছর ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ায় সমুদ্র পথে আমদানি বেশি হয়।
২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চীন, মিশর, ব্রিটেন, মিয়ানমার, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, তুর্কি, ইউক্রেন ও আরব আমিরাত থেকে ৩৫৩ কোটি ৭১ লাখ ২২ হাজার ৪৫৫ টাকা মূল্যের ৮ কোটি ৮০ লাখ ১৯ হাজার ৬০৯ কেজি পেঁয়াজ আমদানি করে।
২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন সমুদ্র পথে ৬৯ লাখ ২৭ হাজার ৯৪৩ টাকার ৪ লাখ ৪২ হাজার ২৬০ কেজি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়।
চিটাগাং চেম্বার সভাপতি বলেন...
দেশের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে আতঙ্কিত হয়ে জনসাধারণকে অতিরিক্ত পেঁয়াজ না কেনা এবং ব্যবসায়ীদেরকে দ্রুত পেঁয়াজ আমদানির আহ্বান জানিয়েছেন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম।
১৫ সেপ্টেম্বর চিটাগাং চেম্বারের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মাহবুবুল আলম বলেন, 'হঠাৎ করে পেঁয়াজের মূল্য খুচরা পর্যায়ে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে ভোক্তাসাধারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেঁয়াজ কেনার জন্য খুচরা দোকানগুলোতে ভিড় করছেন। ফলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এ সুযোগে কিছু পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ী অযথা পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি করছেন। কিন্তু পূর্বের আমদানিকৃত পেঁয়াজের হঠাৎ করে মূল্য বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই।'
তিনি আরও জানান, দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজের মজুদ রয়েছে। আগামী দিনের চাহিদা পূরণে চীন, মিশর, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও তুরস্ক থেকে অতি শিগগিরই পেঁয়াজ আমদানি করার জন্য সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া সড়ক পথেও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে বর্তমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন মাহবুবুল আলম।
এ অবস্থায়, চেম্বার সভাপতি 'পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো কারণ নেই' মন্তব্য করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত না হয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখতে এবং কৃত্রিম সংকটরোধে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেঁয়াজ না কেনার অনুরোধ জানিয়েছেন। পাশাপাশি টিসিবির মজুদকৃত পেঁয়াজ আরও বেশি আউটলেটের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।