গরীবের খামার প্রকল্প সহায়তায় অবস্থাপন্নদের ভাগ
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে আলী হায়দারের একটি ছাপাখানা রয়েছে। তবে, তিনি ২০০৮ সাল থেকে সরকারের "আমার বাড়ি, আমার খামার" প্রকল্পের অধীনে আর্থিক সহায়তা পেয়ে আসছেন। অথচ, প্রকল্পটি দরিদ্র ও গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
দু'তলা বাড়ি এবং জমিজমার মালিক আলী হায়দার বলেন, "প্রকল্পটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা আমার জানা ছিল না। প্রকল্পের কর্মীরা আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেননি।"
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়ন পরিষদের মোহাম্মদ মাসুদ অবস্থাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সাথে শুরু থেকে যুক্ত আছেন। এই প্রকল্পের অধীনে গ্রামের দরিদ্র পরিবার ক্ষুদ্র ঋণ নিতে পারেন। সমিতি থেকে মোহাম্মদ মাসুদ ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন।
পেইন্টের ব্যবসায় জড়িত মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, "আমার মনে হয় না যে প্রকল্প থেকে ঋণ নেওয়ায় কোনো সমস্যা আছে। সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে সমস্যা হওয়ার কথা, কিন্তু আমি সব কিস্তিই পরিশোধ করেছি।"
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুসারে, প্রকল্পের অধীনে ঋণ গ্রহণের জন্য এভাবেই দেশের প্রায় ১০ লাখ অবস্থাপন্ন ও প্রভাবশালী ব্যক্তি সুবিধাভোগীদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
পারিবারিক খামার স্থাপন এবং নিম্ন সুদহারের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আয় সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখাই "আমার বাড়ি, আমার খামার" প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
সুবিধাভোগীর নীতিমালা লঙ্ঘন করে ঋণ ভোগকারী আরেক ব্যক্তি হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পরমানন্দপুর গ্রামের দেলওয়ার। বর্তমানে সিলেটে কাপড়ের ব্যবসা থাকলেও দু'বছর আগে তিনি প্রকল্পের তালিকাভুক্ত হন।
দেলওয়ারের পরিবারের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আলফাজ উদ্দীন বলেন, নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে তাদের জমিজমার পরিমাণ অনেক বেশি।
দেলওয়ার বলেন, "শুরুতে আমি প্রকল্পের অধীনে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিই এবং তা পরিশোধ করি। সাত মাস আগে আমি আরও ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছি।"
প্রকল্পের অধীনস্ত গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়। এগুলো হল- স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, বিবেচনাহীনভাবে নির্বাচন কমিটির সুবিধাভোগী বাছাই এবং ভোট সংগ্রহের উদ্দেশ্য।
লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা মঈন উদ্দীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে কথা বলার সময় জানান, দরিদ্র পরিবারগুলো ঋণ ফেরত দিতে অসমর্থ হওয়ায় তারা ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এবং উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে থাকেন।
প্রকল্পের অধীনে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সারা দেশের অন্যান্য উপজেলাতেও একই ধরনের পরিস্থিতির সন্ধান পায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রাপ্ত অনুসন্ধানী তথ্যের সাথে বিষয়গুলো মিলে যায়।
তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দকৃত অর্থগুলো এখন অনুপযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে প্রণোদনা ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অসঙ্গতি দেখতে পাওয়া যায়। "আমার বাড়ি, আমার খামার" প্রকল্পও ব্যতিক্রম নয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে কোনো তথ্য বা তালিকা না থাকায় এসব হচ্ছে।
ফলে, যোগ্য লোকেরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় জনগণের অর্থ আত্মসাৎ যাচ্ছে। সরকারের দ্রুত একটি তালিকা প্রস্তুত করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
"আমার বাড়ি, আমার খামার" প্রকল্পের পরিচালক আকবর হোসেন বলেন, "প্রকল্পের অধীনে গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে যুক্ত হয়ে কিছু স্বচ্ছল ব্যক্তির ঋণ গ্রহণ করার বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশের সকল সহায়তা কর্মসূচীতেই তা ঘটে থাকে।"
প্রকল্পের শুরুতে যোগ্য নয় এমন লোকের সংখ্যা আরও বেশি থাকলেও সময়ের সাথে তা উল্লেখযোগ্যহারে কমে আসে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সহায়তা গ্রহণকারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে আইএমইডির মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা জানতে পারেন যে, প্রতিটি গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে যুক্ত অন্তত ১১ সুবিধাভোগী দরিদ্র নন। ফলে, বহু প্রকৃত দাবিদাররা সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
গ্রামে উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করে সহায়তা প্রার্থীদের নির্বাচন করার কথা থাকলেও প্রকল্পের নির্বাচন কমিটি তা অনুসরণ করছে না। মাঠ কর্মকর্তারা স্থানীয় মাত্র দুই-একজনের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সমিতির সদস্যদের তালিকা তৈরি করেন।
যেমন, নরসিংদীর রায়পুর উপজেলার বাহেরচর গ্রামের গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সভাপতি আসমা বেগম মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের জানান, তার সমিতির সদস্যদের নির্বাচনে কোনো উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন হয়নি।
প্রকল্পের অধীনে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এক লাখ ২০ হাজার ৪৬৫টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন করা হয় এবং সুবিধা পান প্রায় ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার জন। একেকটি গ্রাম সমিতিতে ৬০ জন সদস্য এবং ৪০ জন নারী সদস্য থাকেন।
মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ব্যক্তিশ্রেণির আয়ের ওপর প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে, সহায়তা গ্রহণকারীদের আয় বৃদ্ধিতে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও কোভিড-১৯ মহামারির কারণে তা হ্রাস পেয়েছে।
প্রকল্পের অধীনে, সুবিধাভোগীদের আয়ের পরিমাণ ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, মহামারির সময় ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উপার্জন হারানোর ফলে আয়ের মাত্রা প্রায় আগের পর্যায়ে চলে যায়।
প্রতিবেদন অনুসারে, মহামারি আঘাত হানার আগে, পুরুষ সুবিধাভোগীদের মাসিক আয় ৮ হাজার ৮৮৭ টাকা থেকে বেড়ে ১২ হাজার ৪৭২ টাকায় গিয়ে পৌঁছায়। অন্যদিকে, নারী সুবিধাভোগীদের আয় ৩ হাজার ৩৮৪ টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার ৫৯৯ টাকায় গিয়ে পৌঁছায়।
"আমার বাড়ি, আমার খামার" প্রকল্পের মূল্য লক্ষ্য ছিলো ২২ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা। কিন্তু, মহামারির সময় এই হার বৃদ্ধি পায়।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায় যে, কোভিড পূর্ব সময়ে দারিদ্র্যের হার ২১ দশমিক ৬ শতাংশ থাকলেও তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪২ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে।
তবে, সরকারের কাছে দারিদ্র্যের হার সংক্রান্ত কোনো সাম্প্রতিক তথ্য নেই।
মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ব্যখ্যামূলক বিশ্লেষণে প্রকল্পের চারটি দুর্বলতার কথা উল্লেখ করা হয়। এগুলো হল- বাছাই প্রক্রিয়ার ত্রুটি, সদস্যদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি, অপর্যাপ্ত ঋণ এবং সদস্যদের মৃত্যুর পর কোনো ঋণ ছাড় না থাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সদস্যদের অনেকেই সফল উদ্যোক্তায় পরিণত হয়েছেন। কিন্তু, ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার সীমিত পরিসরের ঋণের কারণে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।
২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে সুবিধাভোগীদের তালিকাভুক্তির লক্ষ্যমাত্রার ১০৪ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে প্রকল্পটি। তবে, মাঠ পর্যায়ের তথ্যানুসারে, প্রকল্প অঞ্চলের ১০০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কেননা, অতি দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে প্রতি মাসে ২০০ টাকা সঞ্চয় করা সম্ভব নয়। আর তাই, তারা প্রকল্পের আওতাভুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন না।
প্রকল্পের অধীনে, ক্ষুদ্র সঞ্চয় পরিকল্পনা চালু করা হয়েছে। গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সকল সদস্য মাসে সেখানে ২০০ টাকা করে সঞ্চয় করেন। বোনাস হিসেবে সরকার তাদের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করে।
সঞ্চিত এবং সরকারের প্রদত্ত অর্থে গঠিত তহবিল থেকে সমিতির সদস্যরা ৮ শতাংশ সুদের হারে ঋণ গ্রহণ করে আয় সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করেন।
তবে, মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন অনুসারে, অধিকাংশ সদস্যই তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পেয়ে থাকেন যা আয়-সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলস্বরূপ, ঋণ গ্রহীতাদের আয় সৃষ্টিতে এ ধরনের ঋণ খুব একটা সহায়তা করতে পারে না।
অকার্যকর ও অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ:
মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুসারে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচীগুলো অকার্যকর এবং পর্যাপ্ত নয়। ২০০৯ সালে প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পর ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিটি গ্রাম উন্নয়ন সমিতির পাঁচজন সদস্যকে প্রশিক্ষণ দানের একটি কর্মসূচী নেওয়া হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের মাধ্যমে অন্যান্য সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
বাস্তবিক ক্ষেত্রে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচী কোনো কাজে আসেনি। কেননা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যরা অন্যদের শেখানোর মতো সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হন।
আইএমইডি জরিপ অনুসারে, ৪৯২ জন সুবিধাভোগীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারদাতাদের মধ্যে, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। বাকিরা কোনো প্রশিক্ষণের সুযোগ পাননি। অন্যদিকে, মাত্র ১২ শতাংশ নারী সদস্য প্রশিক্ষণ লাভ করেন।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের মধ্যে মাত্র ৫৩ শতাংশ আয়-সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে সক্ষম হন। প্রতিবেদনের সূত্রানুসারে, নারীদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৪৬ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুসারে, সাক্ষাৎকারে অংশগ্রহণকারীরা মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের জানান, যথাযথ প্রশিক্ষণ না পাওয়ায় ঋণ গ্রহণের পরেও তারা উপার্জনে ব্যর্থ হয়েছেন।
২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটির বয়স এখন ১২ বছর। চলতি বছরের জুন মাসে চতুর্থ বারের মতো প্রকল্প কর্মসূচী সম্প্রসারণ করা হয়। প্রকল্পে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। মোট বরাদ্দ থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত ব্যয়ের পরিমাণ ৯২ দশমিক ৪১ শতাংশ।