চীনের অর্থনীতি হোঁচট খেলে শুধু বেইজিংয়ের নয়, ধস নামবে বিশ্ব অর্থনীতিতেও
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন এখন অনেকটা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই বেইজিং 'ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং' বাতিল করছে, আস্থা লঙ্ঘনের দায়ে টেক কোম্পানিগুলোকে করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জরিমানা। যেসব কোম্পানি চীনের কারিগরি শিক্ষাখাতে এতদিন বিনিয়োগ করে বড় অঙ্কের মুনাফা তৈরি করছিল, সেসব কোম্পানিগুলোকেও জোরপূর্বক বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
আরও ভয়ানক কথা হলো, চীনের দ্বিতীয় বৃহতম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার গ্রুপ 'এভারগ্রান্ড' সম্প্রতি তার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। চীনের এই ঘটনা শঙ্কিত করে তুলেছে পুরো বিশ্ব অর্থনীতির বাজারকে। অনেকেই চীনের অর্থনৈতিক মডেলে আবারও নতুন ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভবনা খুঁজে পেয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অর্থনীতিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে চীন হয়তো এখন তার অনেক প্রাইভেট কোম্পানিকেই অর্থনৈতিক সমর্থন দেবে না।
কয়েক দশক ধরে চীন সস্তা শ্রম এবং সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণের উপর নির্ভরশীল। ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে কোম্পানিগুলো তা ব্যয় করেছে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট, কারখানা, সেতু ও অন্যান্য বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে। আর এখন সময় এসেছে এইসব ঋণ পরিশোধের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পরিবর্তে ভোক্তা ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালনার সক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি দেশটির। জনগণের আয় এবং সামগ্রিক ঋণের পরিমাণে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান।
ফলস্বরূপ, চীন নিজের ঋণ ফাঁদে নিজেই আটকে পড়েছে।
চীন সরকার এখন দেশের রিয়েল-এস্টেট ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই এই সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকারের এই চেষ্টায় দেশের প্রবৃদ্ধি নেমে আসবে কিছুটা ধীর গতিতে।
এছাড়া আরেকটি শঙ্কার বিষয় হলো, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটে চীনে কয়লার দাম হয়েছে আকাশচুম্বী। সেইসঙ্গে কর্মক্ষম জনসংখ্যার যে অংশ কয়েক বছরের মধ্যে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অংশে পরিণত হতে চলেছে, তাদের পরবর্তী জীবনযাত্রার জন্য নেই পর্যাপ্ত সঞ্চয়।
এই সমস্ত বাধার মুখে, বেইজিং নতুন এক বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করেছে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে অর্থনীতি মুক্ত করার পরিবর্তে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীনা সমাজতন্ত্র এমন একটি মডেলে ফিরে যেতে শুরু করেছে, যা বিগত কয়েক দশকে দেখা যায়নি চীনে। নতুন এই মডেলে অর্থনীতির বেশিরভাগ অংশ থাকবে কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। এই কারণেই দেশটি আইপিও বাতিল করেছে এবং নতুন নিয়ম নীতিতে পুরো শিল্পখাতকে ঢেলে সাজাচ্ছে।
যেভাবে চীনের অর্থনীতি এ পর্যায়ের এসেছে
চীনের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বোঝার জন্য ফিরে যেতে হবে ১৯৮৪ সালে, যখন তৎকালীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রাধান দেন জিয়াওপিং চীনের অর্থনীতি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময়ে তিনি শিল্পখাতকে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে না রেখে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানকেউ ছেড়ে দিয়েছিলেন নিজের মতো সমৃদ্ধ হতে। রাষ্ট্রের সরাসরি তত্ত্বাবধান ছিল না শিল্পখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর।
তৎকালীন চীন সরকারের এই নীতির ফলে দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং সেইসঙ্গে ঋণ পাওয়াও হয়ে উঠে সহজ। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা মানুষ ঋণ নিয়ে বাড়িঘর ও ব্যবসায় গড়ে তুলতে শুরু করে দেশের বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে। উৎপাদন খাতে দেখা যায় অভাবনীয় উন্নতি। ১৯৯২ সালে যেখানে দেশের ২৭ শতাংশ জনসংখ্যা বাস করত শহরাঞ্চলে; সেই সংখ্যা ২০২০ সাল নাগাদ বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ শতাংশে। এভবেই চলতে থাকে বহু বছর।
অর্থনীতিবিদরা এখন শঙ্কা প্রকাশ করছেন, যেকোনো সময় চীন নিজের ঋণ কৌশল ফাঁদে নিজেই জড়িয়ে পড়তে পারে। সর্বপ্রথম ২০১১ সালে দেশটির অর্থনৈতির এই সংকট পুরো বিশ্বের সামনে উঠে আসে। ২০১৫ সালে চীনের সম্পদ বাজারে আরেকটি ধসের সম্ভবনা দেখা দেয়। তবে সে সময় কর্মকর্তারা বস্তি ভেঙে নতুন ভবনে বাসিন্দাদের স্থানান্তর করে সেই ধাক্কা সামলেছিল।
সে বছর থেকেই চীন সরকার ঋণ ব্যবপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছুটা নড়েচড়ে বসতে শুরু করে। সংকট সামলে উঠতে কিছু কোম্পানিকে চীন ঋণ খেলাপি হওয়ার সুযোগ দেয়, স্থানীয় সরকারদের অপ্রয়োজনীয় কারখানা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি জ্বালানির প্রয়োজন নেই এমন স্থানের কয়লা খনিগুলোও বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকার।
ফলে উন্নত জীবনযাপনের আশায় যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ঋণের উপর ব্যবসা পেতে বসেছিলেন, তারা এখন পড়েছেন সবচেয়ে বড় বিপদে।
চীনের সমাজতন্ত্রে আবারও পরিবর্তন
চীনের সামাজিক বৈষম্য দূর করতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিয় 'কমন প্রোসপারিটি' বা 'অভিন্ন সমৃদ্ধির' পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ কী তা বলা কঠিন। এর অর্থ হতে পারে, বেসরকারিকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল এমন উচ্চ আয়ের নাগরিকদের জন্য বেশি পরিমাণে কর নির্ধারণ করা। অথবা হতে পারে, পুরোনো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই আবার ফিরে যাওয়া। তবে যেটাই হোক না কেন, প্রেসিডেন্ট শির অভিন্ন সমৃদ্ধি কর্মসূচি যদি দেশের নব্য মধ্যবিত্তদের উপর আঘাত হানে তাহলে এটি বর্তমান সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
এখন পর্যন্ত শুধু এতটুকুই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, চীনের শিল্পখাতে কঠোর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আবারও ফিরে আসতে চলেছে।
উদাহরণ হিসেবে আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার কথা বলা যেতে পারে। চীনের এই বিলিয়নিয়ার চীন সমাজে ছিলেন বেশ আলোচিত। তবে তার প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারের নজরদারিতে তিনি এখন আলোচনা থেকে অনেকটাই সরে গেছেন। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে টিকটকের মালিক বাইটড্যান্সের সিইওর ক্ষেত্রেও।
সংকট কাটিয়ে উঠতে গত গ্রীষ্মে বেইজিং 'থ্রি রেড লাইন' নামে পরিচিত নতুন এক ক্রেডিট মেট্রিক্স চালু করেছে। নতুন এই পদ্ধতির আওতায় ঋণের কিস্তি শোধে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে ব্যর্থ হয় এভারগ্রান্ড সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া, এই মাসের শুরুর দিকে ফ্যান্টাসিয়া হোল্ডিংস, নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানও ২০৬ মিলিয়ন ডলার বন্ড পরিশোধে ব্যর্থ হয়।
যাহোক, এ সবকিছুর সঙ্গে জ্বালানি সংকট ও কয়লার দাম বৃদ্ধি চীনের জন্য আগুনে তুষ ঢালার মতই কাজ করছে। এদিকে অস্ট্রেলিয়া থেকেও কয়লা আমদানি বন্ধ করেছে সরকার। ফলে চীনের ৩১ টি প্রদেশের ২০টিই পড়েছে জ্বালানি শক্তি সংকটে, যা উৎপাদন ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। টেলসা ও অ্যাপলের মতো বড় বড় সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে আরও বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
সংকট কাটিয়ে ওঠার উপায়
চীনের এই ক্রমবর্ধমান দুর্দশা কাটিয়ে ওঠা অনেকটাই সহজ হয়ে দাঁড়াবে যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশ চীনের প্রতি সহযোগিতা দেখায়। কিন্তু তা সম্ভব হবে কিনা সেটিই সংশয়ের বিষয়।
প্রেসিডেন্ট শির নেতৃত্বে চীন বিশ্ব মঞ্চে আরও শক্তিশালী ও কঠোর হয়ে উঠেছে। হংকংয়ে গণতন্ত্রে বাধা, জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের উপর অত্যাচার, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রতিবেশীদের দাবিয়ে রাখার মানসিকতা এবং তাইওয়ানকে আগের মতোই হুমকির উপরে রাখার ফলে বহির্বিশ্ব এখন চীনের প্রতি খুব বেশি ইতিবাচক নয়। আর এই সুযোগ পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে।
এই মাসের শুরুতে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক বক্তব্যে মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যাথরিন তাই স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ওয়াশিংটন চায় বেইজিং বাজার উন্মুক্ত করুক ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলুক।
তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে এটুকু বোঝা যায় চীনের অর্থনৈতিক বাস্তবতা খুব শীঘ্রই পরিবর্তিত হবে না। প্রবৃদ্ধি ধীর গতিতে নামিয়ে আনা ছাড়া চীনের কাছে এই মুহূর্তে আর কোনো বিকল্প নেই। আর চীনের প্রবৃদ্ধি কমে গেলে তা অনিবার্যভাবে পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ বিশ্বের অনেক দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে।
শুরু থেকেই আধুনিক চীন পরস্পর বিরোধী এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর গড়ে উঠেছে। দেশটি গতিশীল বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে একযোগে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, যা চীনকে ফেলেছে এক বিশাল ঋণ সংকট।
তবে অর্থনৈতিক আধুনিকায়ন এবং সামাজিক পরিবর্তনের মাঝে চীন সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করেছে দেশটির দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কিন্তু চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সমাধানের জন্য প্রেসিডেন্ট শির প্রচেষ্টা যদি সেই প্রবৃদ্ধিকে থামিয়ে দেয়, তাহলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে। যদি সত্যিই এমনটি ঘটে, তাহলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্বশান্তিও বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে।
- সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার