চীনের ভি-আকৃতির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি হ্রাস পুরো বিশ্বের জন্য অশনি সংকেত
মহামারি অভিঘাত থেকে চীন যে গতিতে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল তার কারণে সৃষ্টি হয় ভি-আকৃতির পুনরুদ্ধার। এই ভি-শেপড রিকভারি তখনই দেখা দেয়, যখন তথ্যের রেখাচিত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যে গতিতে হ্রাস পেয়েছিল ঠিক সে গতিতেই উত্থান লাভ করে। কিন্তু, চীনে এ শক্তিশালী পুনরুদ্ধার গতি হারাচ্ছে; বাকি বিশ্বের জন্যেও তা আসন্ন বিপদের পদধ্বনি। কারণ, পৃথিবীর কারখানা খ্যাত চীনই যদি গতি হারায় তাহলে অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক উত্তরণও কতোটা স্থায়ী হবে-তা নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির নীতি-নির্ধারকদের সাম্প্রতিক পদক্ষেপও বিষয়টিকে আমলে নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত শুক্রবার তাই অর্থনীতিতে বাড়তি অর্থ সঞ্চালনের উদ্যোগ নেয় চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- পিপলস ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি)। ঋণ প্রদানের সক্ষমতা বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আবশ্যক রিজার্ভ আমানতের পরিমাণ ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমায় পিবিওসি।
আগামী ১৫ জুলাই থেকে কার্যকর হতে চলা নতুন নিয়মের কারণে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি ডলার বা এক লাখ কোটি ইউয়ান ঋণ দানে সমর্থ হবে। দীর্ঘমেয়াদে যা অর্থনীতিতে তারল্য সঞ্চার করে উৎপাদন ও পরিষেবাকে উৎসাহিত করবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে রিজার্ভ রেশিও রিকয়্যারমেন্ট (আরআরআর) ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমানোর মতো বড় মাত্রায় ঘোষণা দেওয়াটা প্রত্যাশার চাইতেও বেশি ছিল।
সিদ্ধান্তটি অবশ্য বাস্তব শঙ্কা থেকেই নেওয়া হয়। যেমন; আগামী বৃহস্পতিবার প্রকাশ হতে চলা দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্যে প্রবৃদ্ধি রেকর্ড ১৮.৩ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসার দিকটি উঠে আসবে বলেই অনুমান করছেন ব্লুমবার্গের জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ। একইসঙ্গে, খুচরা পণ্য বিক্রি, শিল্পোৎপাদন ও স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগ পরিমাপের সহায়ক সূচকগুলিও পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছেন তারা।
এ বাস্তবতায় রিজার্ভ রেশিও কমাতে পিবিওসির তড়িৎ পদক্ষেপের উদ্দেশ্য প্রবৃদ্ধির গতি যেন অন্তত সমতল অবস্থানে থাকে এবং একেবারে মুখ থুবড়ে না পড়ে।
প্রাথমিক উত্তরণের কালে চীনের অর্থনীতি যে গতি অর্জন করেছিল তা থেকে নিচের দিকে নামবে এমনটা প্রত্যাশিতই ছিল তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অবস্থা তারা যে সময়ে প্রত্যাশা করেছিলেন তার অনেক আগেই দেখা দিয়েছে; এর প্রভাব অচিরেই বাকি বিশ্বজুড়েও দেখা দিতে পারে।
এব্যাপারে বাজার বিশ্লেষক ও আর্থিক সেবা দাতা কোম্পানি নোমুরা হোল্ডিং ইঙ্কের বৈশ্বিক বাজার গবেষণা শাখার প্রধান রব সুব্বারামন বলেন, "পাঁচ বছর আগে চীনের অর্থনীতি গতি হারানোয় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়েছিল বর্তমানে তার প্রভাব অনেক বেশি হবে, এব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে সর্বপ্রথম ভুগেছে চীন, আবার একইসঙ্গে সবার আগে সেখান থেকে মুক্ত হয়েছে। তাই, পুঁজিবাজারে আশঙ্কা রয়েছে, চীনের অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব কমার অর্থ বিশ্বের অন্যান্য দেশও অচিরেই এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে।"
গত শনিবার ইতালির ভেনিসে জি-২০ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের বৈঠকেও এ আশঙ্কার কথা উঠে আসে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, গতি হারানো প্রবৃদ্ধি বর্তমানের নাজুক বৈশ্বিক উত্তরণকে পথচ্যুত করতে পারে। ভাইরাসের নতুন নতুন ধরনের আবির্ভাব ও টিকাদানে বৈষম্য বৈশ্বিক অর্থনীতির উজ্বল পুনরুদ্ধারের আভাসকে সুদূর পরাহত করবে বলেও জানান তারা।
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আজ সোমবার (১২ জুলাই) বেশ কিছু বিশ্লেষকের উদ্ধৃতি তুলে ধরে জানিয়েছে, অনিশ্চিত বৈশ্বিক উত্তরণের বাস্তবতায় বছরের দ্বিতীয়ার্ধে বা শেষ ছয় মাসে স্থানীয় প্রবৃদ্ধি ধীরগতির হবে।
চীনের পুনরুদ্ধার ধীরগতি হওয়ার অর্থ কারখানা পর্যায়ের মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গেছে এবং তার ফলে কাঁচামালের মূল্যও পরিবর্তন হতে পারে।
এব্যাপারে একমত পোষণ করে বৃহৎ ফরাসী বিনিয়োগ ব্যাংক সোসিয়েট জেনারেলের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ওয়েই ইয়াও বলেন, "চীনের প্রবৃদ্ধি কমার ফলে বিশ্বজুড়ে স্বল্প-মেয়াদে মূল্যস্ফীতি কমে আসার চাপ সৃষ্টি হবে। এতে সবচেয়ে বড় দরপতনের শিকার হবে শিল্পে ব্যবহৃত ধাতু ও প্রধান কাঁচামালের বাজারমূল্য।"
অর্থাৎ, এধরনের কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশ চীনে চাহিদা সংকোচনের ফলে বড় আকারের আয় বঞ্চিত হতে চলেছে। এতে স্থবির হবে কৃষি, খনিজ ও কাঁচামালের অন্যান্য খাত।
তবে ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স সূত্র জানাচ্ছে, মহামারির প্রাথমিক শূন্যতা থেকে স্থিতাবস্থা লাভ করার কারণেই পরিবর্তিত আভাসে চীনে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে।
ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আসার পরও কেন চীনের খুচরা বিক্রিবাট্টা প্রত্যাশিত মাত্রায় বাড়েনি তা নিয়ে এক ধাঁধায় পড়েছেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদেরা। গত জুনে বিক্রি আবারও কমে এসেছিল বলে ধারণা করছে ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স। ওই মাসে স্থানীয় কিছু প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধের কারণে ভোক্তাদের খরচ প্রবণতা হ্রাস পায়।
এ বাস্তবতায় ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসায় তারল্য দিতে পিবিওসি তৎপর হলেও, সঙ্কট শুরুর পর থেকে বর্তমানে কার্যকর থাকা সুনিয়ন্ত্রিত প্রণোদনা সংশোধন করে আরও বৃদ্ধির কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
চলতি সপ্তাহে দ্বিতীয় প্রান্তিকের তথ্য প্রকাশের আগে রিজার্ভ রেশিও কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের কাছে ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশাকে 'ম্যানেজ; করেছে বলে মন্তব্য করেন হংকং ভিত্তিক চায়না রেনেসাঁস সিক্যিউরিটিজের সামষ্টিক অর্থনীতি ও কৌশল গবেষণা শাখার প্রধান ব্রুস প্যাং।
"অর্থনীতির গতি নিশ্চিতভাবেই কমেছে, তাই পিবিওসির এ পদক্ষেপ আগামীতে নীতি সংশোধনের সুযোগও তৈরি করেছে"- যোগ করেন তিনি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ