নতুন জিএসপিতে লাগবে ৪০% মূল্য সংযোজন, প্রণোদনার জন্য ২০% চায় শতাংশ চায় পোশাক খাত
এমন সময়ে দেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকরা সরকারের নগদ প্রণোদনার জন্য নির্ধারিত মূল্য সংযোজন লক্ষ্যমাত্রা কমানোর অনুরোধ করছেন, যখন তিন বছর পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেতে স্থানীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে এই খাতকে।
ইইউ এর প্রস্তাবিত নতুন জেনারাইলজড স্কিম অব প্রেফারেন্স- জিএসপি কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির যোগ্য হতে হলে, বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারকদের 'দ্বিগুণ রূপান্তর'-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিল্পের ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, যা স্থানীয় পর্যায়ে ৪০ শতাংশ হবে। ইতোমধ্যেই এই লক্ষ্যপূরণ করে ফেলেছে নিট পোশাক উৎপাদকেরা। তবে পিছিয়ে উভেনসহ অন্যান্যরা।
বাণিজ্যিক অর্থনীতিবিদ ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করে বলছেন যে, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের পর, অপেক্ষাকৃত অনেক কম স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন নিয়ে ইইউ এর বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিপাকে পড়তে হবে উভেন পোশাক প্রস্তুতকারকদের।
তাদের মতে, পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন-বিজিএমইএ'র দাবি মেনে সরকার এই লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে ২০ শতাংশ করলে তা স্থানীয় পর্যায়ের শিল্পায়নকে অনুৎসাহিত করার পাশাপাশি রপ্তানির স্থানীয় মূল্য সংযোজনের প্রচেষ্টাকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
পোশাক প্রস্তুতকারকরা যাতে তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উপকরণের ব্যবহার বৃদ্ধি করেন, সেজন্য নগদ প্রণোদনা ও রপ্তানিতে ভর্তুকি দেয় সরকার। তবে এসব সুবিধা পেতে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করতে হয়।
তবে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছে পাঠানো এক চিঠিতে, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নগদ প্রণোদনার পাশাপাশি সমস্ত ভর্তুকি পাওয়ার ন্যূনতম মূল্য সংযোজন হার ২০ শতাংশে কমিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছেন।
এব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
কিন্তু, বিশ্লেষক ও শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগদ প্রণোদনা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়। যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য উৎপাদনে স্থানীয় মূল্য সংযোজনে ব্যর্থ হবে; তাদের প্রণোদনার তালিকা থেকে বাদ দেওয়াই হবে যথাযথ পদক্ষেপ।
নাম না প্রকাশের শর্তে পোশাক খাতের একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, সরকার ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজনসহ শুধুমাত্র নতুন পণ্যের জন্য নগদ সহায়তা দিতে পারে, যা পোশাক পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে সহায়ক হবে।
বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, পাঁচটি প্রধান আইটেম রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্জিত হয়। এগুলো বাদে, নতুন কৃত্রিম ফ্যাব্রিক-ভিত্তিক আইটেমগুলির জন্য ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন অনুমোদিত হওয়া উচিত।
এই পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, "নতুন আইটেম হতে পারে স্পোর্টসওয়্যার, বিয়ের পোশাক এবং টেকওয়্যার; যেগুলো প্রস্তুতে আমদানি করা কাপড় এবং আনুষাঙ্গিক উপকরণ প্রয়োজন হয়। একবার আমরা এসব আইটেম উৎপাদন শুরু করতে পারলে, স্থানীয় সরবরাহ শিল্প ধীরে ধীরে বর্ধিত চাহিদার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে।"
এপ্রসঙ্গে বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) সোসাইটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশ এলডিসি স্তর থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে, এই অবস্থায় ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের দাবি যৌক্তিক নয়। কারণ, নতুন জিএসপি প্রস্তাবেও দ্বিগুণ অবদান রাখার শর্ত রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, প্রায় প্রতিটি কাঁচামালের দরবৃদ্ধির কারণে এ শিল্প কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন, কিন্তু সেভাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ছে না। এটি মূল্য সংযোজন হার ধরে রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে সকল বাঁধা সত্ত্বেও এ শিল্পের মূল্য সংযোজন ধরে রাখা উচিত, নাহলে পোশাক প্রস্তুতকারকরা বিদেশি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের সাথে আরও ভালো দামের জন্য দর কষাকষি করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের বার্ষিক নীতি-সহায়তা ও প্রণোদনা সম্পর্কে ভালোভাবেই সচেতন। এসব প্রণোদনার মূল্য হিসাব করেই তারা দর প্রস্তাব করে। তাই দিনশেষে এসব সুবিধায় রপ্তানিকারকেরা নয় বরং তারাই প্রকৃত লাভবান হচ্ছে।
পোশাক প্রস্তুতকারীরা শুধুমাত্র ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজনসহ রপ্তানি করতে চাইলেও ইউরোপীয় দেশগুলিতে রপ্তানিতে জিএসপি'র দ্বিগুণ স্থানীয় অবদানের শর্তপূরণ খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
২০২০ সালে ইইউ ভুক্ত দেশে ২০.৪২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। যার মধ্যে ৯৯১ কোটি ডলার ছিল নিটওয়্যার আইটেম এবং ৭৭১ কোটি ডলার উভেন পণ্য।
এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর ইউরোপের বাজারে এভ্রিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) ফ্যাসিলিটির আওতায় রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় প্রতিবেশী ভারত এবং এমনকি চীনেও রপ্তানি করতে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের দরকার হবে।
তাই পোশাক প্রস্তুতকারকরা এ শর্তপূরণ না করতে পারলে, তাদের সাধারণ জিএসপির অধীনে কর ও শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হবে।
এর আগে সাধারণ জিএসপির অধীনে দীর্ঘসময় ধরে ইউরোপের বাজারে কম মূল্য সংযোজন নিয়েও রপ্তানি করেছে ভিয়েতনাম। তারপর দেশটি ইইউ এর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে এখন শুল্ক মুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার পাচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, "কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায়, আমরা শুধুমাত্র উভেন পোশাকের জন্য ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন চেয়েছি। মূল্যবৃদ্ধির কারণে, রপ্তানিকারকদের জন্য ৩০ শতাংশ নিশ্চিত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।"
তিনি বলেন, সরকার চাইলে পোশাক রপ্তানিকারকদের বেঁধে দেওয়া মূল্য সংযোজনের শর্ত একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ, যেমন- এক বা দুই বছরের জন্য কিছুটা শিথিল করতে পারে।
স্থানীয় মূল্য সংযোজন একেক পণ্যে একেক হারে হয়, কিছু পণ্যে ৪০ শতাংশও হচ্ছে। কিন্তু, উন্নত মানের ও শৌখিন পণ্য উৎপাদনে ৩০ শতাংশ হার নিশ্চিত করাটা বেশ কঠিন। কারণ এসব পোশাক তৈরির কাপড় খুবই উচ্চ মানের, যা আমদানি করতে হয়। এসব পণ্যে অত্যন্ত দামি এক্সেসরিজ ব্যবহারের প্রয়োজন হয় বলেও জানান বিজিএমইএ সভাপতি।
ফারুক হাসান বলেন, "তাই আমরা উভেন আইটেমের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এই সুবিধা চেয়েছি।" এলডিসি গ্রাজুয়েশনের আগেই বাংলাদেশের পোশাক পণ্য আরও স্থানীয় মূল্য অবদান অর্জন করবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।
বেশকিছু কোম্পানি বর্তমানে দেশেই উচ্চমূল্যের সুতা ও এক্সেসরিজ উৎপাদনে বিনিয়োগ করছে। সরকারও এজন্য নীতি-সহায়তা দিচ্ছে।
উচ্চমূল্যের পণ্যগুলিতে স্থানীয় মূল্য সংযোজন উৎসাহিত করতে, সরকারকে মানবসৃষ্ট বা কৃত্রিম তন্তু ভিত্তিক নতুন পণ্যে কমপক্ষে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া উচিত বলে মতপ্রকাশ করেন বিজিএমইএ সভাপতি।
মূল্য সংযোজনের বর্তমান হাল:
পোশাক খাত থেকে স্থানীয় অর্থনীতিতে মোট মূল্য সংযোজন হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে গত তিন প্রান্তিকে তৈরি পোশাক খাতের পর্যালোচনায় সাম্প্রতিক মূল্য সংযোজনের তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।
আরএমজি সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন ৬৪.৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে, টিবিএস দেখতে পেয়েছে যে, মূল্য সংযোজন প্রায় এক দশক ধরে প্রায় ৬০ থেকে ৬৪ শতাংশের মধ্যে স্থির রয়েছে।
অপচয় হার আরও বৃদ্ধির দাবি রপ্তানিকারকদের:
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ অপচয়ের হার ৪০ শতাংশে উন্নীত করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠায় বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ।
বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই অপচয়ের হার সমান, কারণ সবাই একই প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে।
এরপর, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ২০টি কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে প্রকৃত অপচয় হার জানতে চেয়েছিল। শুধুমাত্র দুটি কোম্পানি ব্যুরোর এই অনুসন্ধানে সাড়া দিয়ে জানায়, তাদের অপচয়ের হার ৪০ শতাংশের বেশি।
এরপর পোশাক কারখানায় প্রকৃত অপচয় হার যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মৌলিক নিটওয়্যার, বিশেষ আইটেম এবং সোয়েটার এবং মোজা উৎপাদক ছয়টি কারখানা পরিদর্শন করার পর কমিটি একই রকম কারখানার অপচয়ের পরিমাণ গড় করে, সর্বাধিক অপচয় হার নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।
কমিটি টি-শার্ট, পোলো শার্ট, ট্রাউজার, শর্টস, স্কার্ট, পায়জামাসহ মৌলিক নিটওয়্যারের জন্য ২৫ শতাংশ অপচয় হারের প্রস্তাব করেছে। রোমপার, ট্যাঙ্ক টপস, ড্রেস, গাউন, হুডি এবং অন্তর্বাস আইটেমের মতো বিশেষ আইটেমগুলির জন্য ২৮ শতাংশ এবং জাম্পার, পুলওভার, কার্ডিগান, ভেস্ট এবং মোজার মতো আইটেমগুলির জন্য ৩ শতাংশ অপচয় হার নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে।