পশুখাদ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, বিপাকে ডেইরি খাতের উদ্যোক্তারা
অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পশুখাদ্যের দাম। গত এক মাসে বাজারে পশুখাদ্যের প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। বেকারি পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে দুধের চাহিদা ও দাম কমলেও পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ডেইরি খাতের উদ্যোক্তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে ফিডের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিতে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার সাঙ্গু ডেইরি ফার্মের খামারি মো. জসিম উদ্দিন। গত ৫ বছর ধরে গরুর খামার পরিচালনা করছেন তিনি। দিনে গড়ে ১০০ কেজির বেশি দুধ বিক্রি করে স্বচ্ছলতার সাথে চলছিল খামারটি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে লোকসানের মধ্যে ছিল এই খামার। বর্তমানে লকডাউন উঠে গেলেও পশুখাদ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিতে সংকটে পড়েছেন তরুণ উদ্যোক্তা জসিম উদ্দিন। উৎপাদন খরচের চেয়েও দুধের দাম কম হওয়ায় খামার বন্ধ করে দেয়ার উপক্রম হয়েছে তার।
একই অবস্থা চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খামারিদের। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়া, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি ছাড়াও শিপিং চার্জ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধিজনিত কারণে সারাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর খামারিরা সংকটে দিন পার করছে। পশুখাদ্যের দাম বাড়লেও দুধের দাম আশানুরূপ বৃদ্ধি না পাওয়ায় খামারগুলোর দৈনিক আয়ে বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক খামারে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি লিটার দুধ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করা হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। প্রতিদিন একটি গাভীকে যে পরিমাণ খাদ্য খাওয়ানো হয়, তার হিসাবে প্রতি লিটার গরুর দুধ বিক্রিতে খামারিদের তেমন একটা লাভ থাকছে না। তাছাড়া বেকারি কিংবা মিষ্টিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুধের চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেক সময় আরও কম দামে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে খামারিদের। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে দেশের বাজারে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। ওষুধসহ খামার পরিচালনায় বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে গেলেও দুধের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পরিচালন ব্যয় নিয়ে সংকটে পড়েছে খামারিরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ও পাহাড়তলী পাইকারি বাজারের বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় চিকন ভুসি হিসেবে পরিচিত পশুখাদ্য বস্তাপ্রতি (৫৫ কেজি) ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে দাম বেড়ে ১ হাজার ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাতা ভুসির দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ৯০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪০০ টাকায়, ভুট্টা প্রতি কেজি ২০ থেকে বেড়ে ৩০ টাকা, খৈল বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১ হাজার ৭০০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৩৫০ ও ধানের কুঁড়া বস্তাপ্রতি (৪০ কেজি) ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়াও কেজিপ্রতি সয়ামিল আগে ৩০-৩২ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ৪৭ থেকে ৪৮ টাকায়, মসুর ডালের ভুসি (৩০ কেজি) ৩০০ টাকা বেড়ে ৯৫০ টাকায়, মুগডালের ভুসি ২০০ টাকা বেড়ে বস্তাপ্রতি (৪০ কেজি) ১ হাজার ৪৬০ টাকায়, ছোলার ভুসি (২৫ কেজি) প্রায় সমপরিমাণ বেড়ে ১ হাজার ৩২০ টাকায়, আটা কুরা (৫০ কেজি) ২৫০ টাকা বেড়ে বস্তাপ্রতি ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪২০ টাকায়, চালের খুদ (৫০ কেজি) বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৩৮০ টাকা থেকে ১ হাজার ৪২০ টাকায়, সয়াবিনের ছাল বস্তাপ্রতি (৩৫ কেজি) ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ২০ থেকে ১ হাজার ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গম, ধান ও ডালের দাম বৃদ্ধির কারণে পশুখাদ্যের বাজারে নতুন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম নগরীর মেসার্স ইভা ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী আবু ইউসুফ বলেন, "দিনদিন যেভাবে পশুখাদ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ফার্ম করা কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও শ্রমিকের মজুরি দিয়ে বর্তমানে প্রতি লিটার দুধ উৎপাদনে খরচ পড়ছে প্রায় ৬৩ টাকা। কিন্তু বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে ৫০-৫২ টাকার মধ্যে"।
চিটাগাং ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ওমর বাবু জানান, "পশুখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন খামারিরা। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর দুধের সরবরাহ বাড়লেও দাম বাড়ছে না। চিনি, ভোজ্যতেল ও আটা-ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায় বেকারি পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। যার কারণে উৎপাদিত দুধও সময়মত বিক্রি করা যাচ্ছে না"। এভাবে চলতে থাকলে লোকসানে যে কোন সময় খামার বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
পশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে পশুখাদ্যের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ছাড়াও বৈশ্বিক শিপিং চার্জ বেড়ে যাওয়া সবচেয়ে বেশি দায়ী। মূলত গত এক বছরে আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজের ভাড়া প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ কম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চীনমুখী জাহাজ বুকিংয়ের কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু শিপিং লাইন বাংলাদেশে আসার আগ্রহ দেখালেও দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া দাবি করছে। যার কারণে আমদানি-নির্ভর অধিকাংশ পশুখাদ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব না হওয়ায় চাহিদা মৌসুমকে সামনে রেখে দেশে পশুখাদ্যের বাজার আগামী কয়েক মাস ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এগ্রোটেক পোলট্রি অ্যান্ড অ্যানিমেল ফুডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মো. শাহজালাল বলেন, "আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশে পশুখাদ্যে সবচেয়ে বড় সংকট দেখা যাচ্ছে। এক বছর আগেও প্রতি টন পণ্যের শিপিং চার্জ ছিল মাত্র ৫০০ ডলার। বর্তমানে চীনের আমদানি বৃদ্ধির প্রবণতায় শিপিং চার্জ তিনগুণ বেড়েছে। এতে আমদানি মূল্যের চেয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে"। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একই কারণে চাল, ডাল ও গমের বাজার বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় পশুখাদ্য উৎপাদনকারীরাও বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
চাক্তাই এলাকার পাইকারি ডেইরি-পোল্ট্রি খাদ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হাজী জয়নাল আবেদীন স্টোরের স্বত্বাধিকারী হারুনুর রশিদ বলেন, "প্রতিমাসেই পশুখাদ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। মিল পর্যায় থেকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অযুহাতে দাম বাড়ানোর ফলে পাইকারি পর্যায়েও বাড়তি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে আমদানিকৃত পশুখাদ্যের সরবরাহ কিছুটা কমে যাওয়ায় বাজারে কৃত্রিম সংকট ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে"।