প্রশিক্ষণ আছে, নেই অর্থায়ন
কক্সবাজারের ওমর হাসান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন দুই বছর আগে। তিনি তার দুই বন্ধুকে নিয়ে তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সামুদ্রিক শৈবাল থেকে ওষুধের শিল্পের কাঁচামাল তৈরির উদ্দেশ্যে রপ্তানিমুখী একটি কারখানা স্থাপন করেছেন কক্সবাজারের বিমান বন্দর সড়কে।
জার্মান প্রযুক্তির এ কারখানায় ইতোমধ্যে ৭০০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগামী ছয় মাসে কর্মসংস্থান এক হাজার জনে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি। বিডার প্রশিক্ষণের পর মারি কালচার বিজনেসে আরও অভিজ্ঞতা নিতে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াও সফর করছেন তিনি। তার এ কারখানা ব্যাপক সম্ভাবনা দেখালেও ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছেন না তিনি। শৈবাল থেকে ওষুধের কাঁচামালের চাহিদা রয়েছে বিশ্বব্যাপী। কিন্ত কারখানা সম্প্রসারণে অর্থায়ন জটিলতায় পড়েছেন। ভূমি বন্ধক রেখে তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৬০ কোটি টাকার ঋণের আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এখন বিদেশে থেকে ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছেন ওমর।
জৈবপ্রযুক্তিতে এমএসসি পাস করা ওমর হাসান জানান, ইতোমধ্যে কোরিয়া, চিলি এবং চীনে তার পণ্য রপ্তানি শুরু করেছেন। এখন প্রায় ১০০ টন পণ্য (টাকার অংকে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা) তিনি রপ্তানি করছেন। রপ্তানি চাহিদাও বাড়ছে।
বিডার উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের ডাটাবেজে ওমর হাসানকে 'উদ্যোক্তা' হিসেবে দেখানো হয়েছে। ওমর হাসান ব্যাংক ঋণ না পেয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে কোনোভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন । কিন্ত উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া বেশিরভাগ প্রশিক্ষার্থী উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হতে পারছে না, শুধুমাত্র ঋণ সুবিধা না পাওয়ার কারণে।
বিডার তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ২৪,৯০০ জন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০,৬৫৫ জনই উদ্যোক্তা হতে পারেনি। মূলত অর্থায়নের অভাবে এসব প্রশিক্ষণ নিয়েও এরা উদ্যোক্তা হতে পারেনি। অন্যদিকে উদ্যোক্তা হয়েছেন ৪২৪৫ জন বা ১৭%।
টিবিএসের পক্ষ থেকে উদোক্তাদের (যাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গণ্য করছে বিডা) ২০ জনের সঙ্গে দৈবচয়নের ভিত্তিতে কথা বলে জানা গেছে, এদের মধ্যে মাত্র চার জন ব্যাংক ঋণ সুবিধা পেয়েছেন। বাকিরা চেষ্টা করেও ঋণ সুবিধা এখনও পায়নি। তবে তারা ব্যবসায়িক উদ্যোগ দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েও উদ্যোক্তা হতে পারেনি এমন ২৫ জন প্রশিক্ষার্থীর সঙ্গেও কথা বলেছে টিবিএস। এর মধ্যে অনেকে কয়েক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে ঋণের জন্য ব্যাংক থেকে ব্যাংক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্ত এখনও ব্যাংক থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। এ কারণে তারা সফলও হতে পারছে না।
রংপুরের শরীফ-উর-রহমান জানান, ইউরোপের একজন ক্রেতার জন্য তিনি জিন্স প্যান্ট উৎপাদনের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ব্যাংক ঋণের আবেদন করেও তা পাননি। আপাতত তিনি তিন লাখ টাকার ঋণ চেয়েছেন। কিন্ত এত স্বল্প পরিমাণের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছেনা।
মাগুরার ইমরুল ইসলাম একটা গরুর খামার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৬ লাখ টাকার ঋণ আবেদন করছেন। মরগেজসহ নানা অজুহাতে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান। তিনি বলেন – কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঋণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকারের বিশেষায়িত ব্যাংকও রয়েছে, সেখানে গিয়ে ঋণ পাওয়ার কোনো আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে না।
কক্সবাজারের ফয়সাল উদ্দিন জানান, তিনি ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবসা করতে চান। ইতোমধ্যে তিনি প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো যোগাড় করছেন। কিন্ত আরও ১০ লাখ টাকার মতো তার প্রয়োজন। এ টাকা যোগাড় করতে বিভিন্ন ব্যাংকে যাচ্ছেন। কিন্ত কোনো ব্যাংক সাড়া দিচ্ছে না।
একই অবস্থা নোয়াখালীর বিবি মরিয়াম, জামালপুরের ফারজানা আফরোজ, চট্টগ্রামের ফাহমিদা শর্মি, মৌলবীবাজারের আকবর আলী, জামালপুরের রাসেল আহমেদ, ময়মনসিংহের আহ্মেদ আল নূর, সিলেটের নাজনীন সুলতানা, রাজবাড়ীর ইমরান খানসহ অনেকের।
সারা দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী সম্ভাবনাময় বেকার ও শিক্ষিত যুবকদের বিনিয়োগ সংক্রান্ত ধারণা দেওয়া এবং প্রচলিত আইন, পদ্ধতি, বিধি-বিধান, নিয়ম-কানুন ও মূলধনের সংস্থানসহ বিভিন্ন বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৯ সালে ।
উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন বহুজাতিক ও আন্তর্জাতিক ভারী ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে প্রাথমিক ও মধ্যম পর্যায়ের কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ বা কম্পোনেন্ট সরবরাহের জন্য স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে 'সাপ্লায়ার এন্ড লিংকেজ ডেভেলপমেন্ট' এর মাধ্যমে দক্ষ উদ্যোক্তা সৃষ্টিই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল। ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রশিক্ষণের কাজ শেষ হয়েছে।
এক মাসের এই প্রশিক্ষণ ছাড়াও স্থানীয় ব্যবসায়ী, চেম্বার , অ্যাসোসিয়েশন অথবা সফল কোনো ব্যবসায়ীকে নতুন উদ্যোক্তাদের 'মেন্টর' হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। প্রশিক্ষণ চলাকালে উদ্যোক্তারা ব্যবসা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং মেন্টরদের পরামর্শে তা চূড়ান্ত হয়।
উদ্যোক্তাদের সার্বক্ষণিক (২৪ ঘন্টা) বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে একটি অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মও তৈরি করা হয়েছে। এ প্লাটফর্মে সার্বক্ষণিক তথ্য দিয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য দুই অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেওয়া হয়।
উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে প্রতি জেলায় স্থাপন করা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে উদ্যোক্তা সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়। মূলধন বা আর্থিক সহায়তা পেতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের যোগাযোগেরও ব্যবস্থা করা হয় প্রকল্পের আওতায়। এছাড়া বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সংযোগ তৈরিতে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক একেএম হাফিজুল্লাহ খান বলেন, ৬১,১৫০ জন আবেদনকারী থেকে অনেক যাচাই-বাছাই করে ২৪,৯০০ জনকে নেওয়া হয়েছে প্রশিক্ষণের জন্য। যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের ছোট খাত পুঁজি বিনিয়োগের জন্য তৈরি হয়ে আছে। কিন্ত কোনো বিশেষায়িত বা সরকারি ব্যাংক থেকেও কোনো ধরণের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, শুধু ভালো প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না। তাদের মূলধনের যোগান দিতে হবে । তা না হলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে প্রশিক্ষণ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। এরপরও প্রকল্প থেকে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৭% উদোক্তা হয়েছে, এটা অনেক বড় অর্জন।
বিডার কর্মকর্তারা জানান, এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা (৪২৪৫) উদ্যোক্তা হয়েছেন, তারা এখন পর্যন্ত ১০.৭৯ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ বিনিয়োগের কারণে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৩৮০০০ জনের। যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা সবাই যদি বিনিয়োগে আসতে পারে, তাহলে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
তবে এটিই একমাত্র প্রশিক্ষণ প্রকল্প নয় যেখানে দক্ষতার বিকাশের জন্য ব্যয় করা অর্থ মূলধনের অভাবে উদ্দেশ্যমূলক ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত মার্চ মাসে টিবিএস নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আইটি প্রশিক্ষণ প্রকল্প নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন ছেপেছিল।
জাতীয় মহিলা সংস্থা গত ৮ বছরে ৩২, ৭৩১ জন নারীকে ছয়মাস ব্যাপী একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করে কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ০.৬২% বা ২০৫ জন নারী শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তা হতে সক্ষম হয়। প্রকল্প পরিচালক নাজমুল হোসেন খান এর মতে, এসব নারীর দক্ষতা প্রশিক্ষণ কাজে না লাগানোর পেছনে অর্থায়নের অভাবই ছিল প্রধান কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান টিবিএসকে বলেন, প্রকল্প থেকেই নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের ব্যবস্থা করার সুযোগ ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার র্স্টাট-আপ তহবিল রয়েছে। এ তহবিলে ঋণের সুদ মাত্র ৪%। এ তহবিল থেকে বিডার প্রকল্পের মাধ্যমে যারা উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাদের জন্য ১০০ কোটি দেওয়া যেতে পারে। এতে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা শুরু করতে পারবে। এছাড়া প্রয়োজনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও উদ্যোক্তার অর্থায়নে প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে তিনি জানান।