বাড়ছে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা ক্লাবের সদস্য
মোবাইল অপারেটর হিসেবে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের বাজারে ব্যবসা শুরু করে গ্রামীণফোন। যাত্রা শুরুর কয়েকবছরের মধ্যেই এ খাতের শীর্ষস্থানে পৌঁছে যায় প্রতিষ্ঠানটি। মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের বাজারে ব্যবসা করা প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম লেখায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়ের এ কোম্পানিটি।
গ্রামীনফোনের এই সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল তৎকালীন সরকারের নীতি। সে সময়ে সরকার টেলিকম খাতকে বেসরকারি খাতে প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত করেছিল। যার ফলে দেশব্যাপী সেলফোনের রমরমা বাজার তৈরি হয় এবং বর্তমান সময়ের ইন্টারনেট বিপ্লব হয়ে উঠে সহজ।
এরপর দ্রুতই এই টেলিকম জায়ান্টের পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্যাংকিং, প্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং তামাকসহ বিভিন্ন খাতের কমপক্ষে এক ডজন তালিকাভুক্ত কোম্পানি যোগ দেয় ৫০০ কোটি টাকার বার্ষিক মুনাফার ক্লাবে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বার্ষিক মুনাফা এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
তবে এই যাত্রা সবার জন্য একরকম ছিল না।
তামাকজাত পণ্যের ব্যবসা করা বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (ব্যাট) এর জন্য এই যাত্রা ছিল দীর্ঘ ৬৫ বছরের। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো ব্যাটের বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ কোটি টাকা। ভোক্তা পর্যায়ে তামাকজাত পণ্যের ব্যবহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং অন্য প্রতিযোগীদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে বাজার দখলের মাধ্যমে এ পর্যায়ে পৌঁছাতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
সরকারের অনুকূল নীতি, উদ্যোক্তাদের দূরদৃষ্টি এবং বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিং এবং বিদ্যুৎ খাতও বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
বিশ্লেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, চলতি দশকের শেষ নাগাদ ৫০০ কোটি টাকা মুনাফার ক্লাবের সদস্য দাঁড়াতে পারে ১০০তে। তবে, ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস (এফএমসিজি) ও টেক্সটাইল খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই তালিকাভুক্ত না হওয়ার এ হিসাবের বাইরে তারা রয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পরপরই যাত্রা শুরু করে দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো লিমিটেড। অনেকগুলো সহযোগী একীভূত হওয়ার পাশাপাশি উচ্চ মুনাফার ফলে ২০১০ সালে বেক্সিমকো বার্ষিক ৫০০ কোটি টাকা মুনাফার মাইলফলকে পৌঁছেছিল।
সে বছর এই পরিমাণ মুনাফা অর্জনের পর, প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছর আবারও ৫০০ কোটি টাকার মুনাফার তালিকায় ফিরে এসেছে। করোনা মহামারির ফলে বেক্সিমকোর উৎপাদিত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) রপ্তানির পাশাপাশি টেক্সটাইল এবং আইটি পণ্যসহ এর অন্যান্য ব্যবসায়িক আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশের ওষুধ শিল্পের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসও এ বছর ৫০০ কোটি টাকার মুনাফা ক্লাবে প্রবেশ করেছে।
চার দশক আগে সরকারের যথাযথ নীতি দেশকে ওষুধ শিল্পে স্ব-নির্ভর হতে সাহায্য করেছে। যার ফলে দেশের শীর্ষ কোম্পানিগুলো এখন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে ওষুধ রপ্তানি করছে।
১৯৬৪ সালে ছোট্ট পরিসরে ব্যবসায় শুরু করা স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস এখন দেশের ওষুধ শিল্পের শীর্ষস্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটি ২০১৫ সাল থেকেই ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা ক্লাবের সদস্য। এ বছর স্কয়ারের বার্ষিক মুনাফা বেড়ে দাঁড়িয়ে এক হাজার ৫৯৪ কোটি টাকায়।
ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যালস বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে ১৯৭২ সালে। ১৯৯৩ সালে কোম্পানিটির মালিকানা গ্রহণ করে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। তখন প্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যালস রাখা হয়। ২০০০'র দশকের শুরুতে বার্ষিক প্রায় ১০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করত রেনাটা। চলতি বছর কোম্পানিটি বার্ষিক ৫০০ কোটি টাকা মুনাফার ক্লাবে প্রবেশ করেছে।
মুনাফার এই মাইলফলকে পৌঁছানো সব কোম্পানিই এই পর্যায়ে আসতে কয়েক দশক সময় নিয়েছে এবং আরও বেশি শক্তিশালী হওয়ার জন্য ধীরে ধীরে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
গত এক দশকে দ্রুততম বৃদ্ধি
গত দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং হাই-টেক ম্যানুফ্যাকচারিং খাতও দ্রুত বিকশিত হয়েছে। কারণ অর্থনীতি এবং জনগণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার এই খাতগুলোকে নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছে।
উদাহরণ হিসেবে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কথা বলা যেতে পারে। কোম্পানিটি ২০০৭ সালে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডের কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ শুরু করেছিল; এটি এখন দেশের সর্বোচ্চ লভ্যাংশ অর্জনকারী স্থানীয় তালিকাভুক্ত কোম্পানি।
ইউনাইটেড পাওয়ার তার দুটি নিজস্ব ব্যবসায়িক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বেশ কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণের মাধ্যমে ২০১৯ সালে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফার মাইলফলকে পৌঁছায়। এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান বার্ষিক আয় এক হাজার কোটি টাকার উপরে।
সরকার বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই ১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করে সামিট পাওয়ার। সরকারের সঙ্গে একাধারে অনেকগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে দেশের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে।
বিনিয়োগকৃত মূলধনের উপর প্রয়োজনীয় রিটার্ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলিকে একীভূত করে, সামিট পাওয়ার ২০১৯ সালে ৫০০ কোটি টাকার মুনাফা ক্লাবে প্রবেশ করেছে এবং চলতি বছরে প্রতিষ্ঠানটির লাভের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
ইলেকট্রনিক্স এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস জায়ান্ট ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় এই কোম্পানিটি যাত্রা শুরুর মাত্র ৭ বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। আর এখন এর বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ এক হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি।
২০০৮ সালে মাত্র ১০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। সরকারের সহায়ক নীতির ফলে প্রতিষ্ঠার পর দ্রুতই রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স পণ্যের স্থানীয় বাজারে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয় ওয়ালটন।
ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় ওয়ালটনের জনপ্রিয়তা বেশি। স্থানীয় বাজারে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে পরাজিত করা ওয়ালটন এখন ইলেকট্রনিক্সের শীর্ষস্থানীয় গ্লোবাল প্লেয়ার হওয়ার লক্ষ্যের দিকে আগাচ্ছে।
এক লক্ষ রেফ্রিজারেটর রপ্তানি, কম্প্রেসরসহ আরও নানা ধরনের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম রপ্তানির নতুন নতুন চুক্তিতে পৌঁছেছে ওয়ালটন। কোম্পানিটির সাম্প্রতিক এই অগ্রগতিতে বলা যায়, উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি ঠিক পথেই এগোচ্ছে।
জাতীয় অর্থনীতির আকার যত দ্রুত বাড়ছে বিনিয়োগ, বাণিজ্য অর্থায়ন, সঞ্চয় এবং ঋণ - সবকিছুই দ্রুতগতিতে বাড়ছে এবং দেশের ব্যাংকগুলোও বড় মুনাফাদাতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
তবে, এক দশক ধরে খেলাপি ঋণ ও বিনিয়োগ ঝুঁকির বিরুদ্ধে সরকার যে বিধি নিষেধ নির্ধারণ করেছে, তা প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সাহায্য করেনি।
২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ন্যাশনাল ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা বার্ষিক মুনাফা অর্জন করে। তবে, ব্যাংকিং খাতের অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠনের চেয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক সর্বোচ্চ পরিশোধিত মূলধন গড়ে তুললেও পরবর্তী বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি তার অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি।
দেশের বেসরকারি খাতের বৃহত্তম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৮ সালে এই ক্লাবে প্রবেশ করলেও পরের বছরগুলোতে আবারও নিচে নেমে যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উভয় ব্যাংকই ৫০০ কোটি টাকা মুনাফার মাইলফলকের কাছাকাছি রয়েছে।
স্থানীয় এবং ডাচ উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক যৌথ-উদ্যোগের ফল হিসেবে ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করে ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো ৫০০ কোটি টাকা বার্ষিক মুনাফা করেছিল।
অন্যান্য খাতের পাশাপাশি দেশে নির্মাণ খাতও বিকশিত হচ্ছে। সেই ফলশ্রুতিতে শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত নির্মাতা বিএসআরএম লিমিটেডও অভিজাত এই ক্লাবের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করেছে। ১৯৬০ সালে যাত্রা শুরু করা তালিকাভুক্ত এই কোম্পানিটির এ বছরের মুনাফার দাঁড়িয়েছে ৪৯৭ কোটি টাকায়।
৫০০ কোটি টাকা মুনাফার ক্লাবে প্রবেশের পথে ১০০ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান
সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের প্রাক্তন সভাপতি শহিদুল ইসলাম মনে করেন, বছরে ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করছে এমন বাংলাদশি কোম্পানির সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি। কারণ খুব অল্প সংখ্যক বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে, যারা তাদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে।
উদাহরণ স্বরূপ ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই খাতের শীর্ষ দশটি সংস্থার দুই-তৃতীয়াংশই ব্যক্তিগত এবং বেশিরভাগ এফএমসিজি জায়ান্ট এখনও স্টক মার্কেটের বাইরে রয়েছে। এছাড়া, বড় বড় টেক্সটাইল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও তালিকাভুক্তি ছাড়াই কাজ করছে।
ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামও এই দশক শেষ হওয়ার আগেই ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জনকারী তালিকাভুক্ত সংস্থার সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন। কারণ অনেক তালিকাভুক্ত সংস্থা তাদের বিদ্যমান ভিত্তি থেকে মুনাফার পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, "একটি কোম্পানি তার প্রথম বার্ষিক মুনাফায় ৫০০ কোটি টাকা আয় করতে যে সময় নেয়, তা প্রতি বছর অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরবর্তী ৫০০ কোটি টাকা আয়ের সময় এক দশকেরও কম সময়ে নেমে আসবে।"
তিনি আরও মনে করেন, কিছু সময়ের মধ্যেই ব্যাংকিং খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান ৫০০ কোটি টাকা মুনাফা অর্জনের তালিকায় জায়গা করে নেবে।
তিনি বলেন, "আগামীকাল হয়তো আমরা এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে কথা বলব।"
- মূল নিউজটি ইংরেজিতে পড়ুন: Quiet grows the Tk500cr profit makers' club
- বাংলায় অনুবাদ: জান্নাতুল তাজরী তৃষা