বিকাশের ২০ শতাংশ শেয়ার কিনছে জাপানের সফটব্যাংক
মোবাইল ফোনে দেশের বৃহত্তম আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) বিকাশ- এর ২০ শতাংশ অংশীদারিত্ব কিনে বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করতে চলেছে প্রযুক্তিখাতে জাপানি বিনিয়োগ জায়ান্ট সফটব্যাংক। শেয়ার অধিগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পর বিকাশে পঞ্চম বিদেশি বিনিয়োগকারী হবে সংস্থাটি।
বিকাশ- এর অধিকাংশ শেয়ারের মালিক ব্র্যাক ব্যাংক এক বোর্ড সভায় বর্তমান শেয়ারহোল্ডারদের সাথে প্রস্তাবিত বিনিয়োগকারী সফটব্যাংকের শেয়ার ক্রয় এবং সাবস্ক্রিপশন চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর মাধ্যমে ২০ শতাংশ শেয়ার কিনবে সফটব্যাংক।
বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ঘোষণায় ব্র্যাক ব্যাংক জানিয়েছে, বিনিয়োগের শর্তাবলী অনুসারে, সফটব্যাংক বিকাশ- এর প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি দুই ধরনের শেয়ারের মোট ২০ শতাংশ কিনবে।
নতুন বিনিয়োগের ফলে বিকাশ- এ তাদের শেয়ার মালিকানায় কোনো পরিবর্তন হবে না বলে জানিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। সফটব্যাংকের সাথে বিকাশ- এর অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারদের লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার পরও ব্র্যাক ব্যাংক-ই সিংহভাগ মালিকানায় থাকবে।
বর্তমানে বিকাশের বিদেশি বিনিয়োগকারীর মধ্যে রয়েছে মানি ইন মোশন এলএলসি, আইএফসি, দ্য বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং আলিপে সিঙ্গাপুর ই-কমার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
ইতঃপূর্বে ভারতীয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম- ফ্লিপকার্ডে বিনিয়োগকারী সফটব্যাংকের ফান্ড বিকাশের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি উভয় ধরনের শেয়ার কিনতে পুঁজি লগ্নী করবে। অর্থাৎ, নতুন শেয়ারের পাশাপাশি বর্তমানে বিকাশ- এর অংশীদারিত্বে থাকা এক বা একাধিক বিনিয়োগকারী সংস্থার অধীনে থাকা শেয়ার কিনবে সফটব্যাংক ।
এর আগে, সফটব্যাংকের ভিশন ফান্ড-১ ভারতীয় এমএফএস পেটিএম- এ বিনিয়োগ করেছে।
প্রযুক্তিখাতের শীর্ষ জাপানি সংস্থাটি এমন সময় বিনিয়োগে আসছে যখন গত দুই বছর ধরে টানা লোকসানের মুখ দেখেছে বিকাশ। গত বছর বিকাশ ৮১ কোটি টাকা লোকসান দেয়।
লোকসানে থাকলেও পর্যায়ক্রমে বাড়ছে কোম্পানিটির বাজার অংশীদারিত্ব। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করে দেশের এমএফএস বাজারে আধিপত্য ধরে রেখেছে বিকাশ।
২০১৮ সালে চীন-ভিত্তিক প্রযুক্তি জায়ান্ট আলিবাবা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আলিপের বিনিয়োগের পর প্রযুক্তি উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ শুরু করে বিকাশ। ওই সময় বিকাশের ২০ শতাংশ শেয়ার কিনে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছিল আলিপে।
প্রযুক্তিতে এ বিনিয়োগ বিকাশের বাজার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সুফলই বয়ে আনে। ২০২০ সালে যার বদৌলতে স্থানীয় এমএফএস বাজারের ৮৫ শতাংশ সক্রিয় গ্রাহক কোম্পানিটির সাথে যুক্ত হয়। যেসব, ভোক্তা ৯০ দিনে অন্তত একবার মোবাইলভিত্তিক আর্থিক লেনদেন করেছেন, তারাই হলেন সক্রিয় গ্রাহক।
এছাড়া, দেশের এমএফএস বাজারের ৫০ শতাংশ নিবন্ধিত ভোক্তাই হলেন বিকাশ গ্রাহক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষপর্যন্ত দেশে মোট এমএফএস একাউন্ট সংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৯৩ লাখ। যার মধ্যে ৫ কোটির বেশি একাউন্ট বিকাশের।
বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদির বলেন, "সাম্প্রতিক দফায় বিনিয়োগের উদ্যোগটি আমাদের গত ১০ বছরের নিরলস অধ্যাবসায় ও নিষ্ঠার প্রতিফলন। এতে সম্ভাবনাময় ও সুনিয়ন্ত্রিত ফিনটেক স্পেসে বিনিয়োগকারীদের আস্থার দিকটি উঠে এসেছে।"
"এ বিনিয়োগ বিকাশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আস্থা ভোট। যার ফলে, বাংলাদেশের অন্যান্য উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবকদের জন্য দেশ ও অর্থনীতির সফল ডিজিটাল রূপান্তর তুলে ধরার মাধ্যমে বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণের পথ সুগম হলো," - তিনি বলেছেন।
সফটব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার্সের ম্যানেজিং পার্টনার গ্রেগ মুন বলেন, "আর্থিক সেবার পরিধি বিস্তার বলিষ্ঠ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য। আমরা মনে করি, জনগণকে সহজে ও নিরাপদে ডিজিটাল লেনদেনের সেবা দিয়ে বিকাশ বাংলাদেশের আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণে ভূমিকা রাখছে। সুলভ, নির্ভরযোগ্য ও সহজে ব্যবহারযোগ্য সেবা নিশ্চিত করে কোম্পানিটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য নিয়েছে। এই লক্ষ্যপূরণে আমরা কামাল কাদির ও বিকাশ টিমের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে ভীষণ উৎসাহী।"
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর. এফ. হোসেন জানান, এ বিনিয়োগ কোম্পানির সাথেসাথে অর্থনীতির ওপরেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আসা গত ১০ বছরে দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির স্বীকৃতি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশের পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বড় উল্মফন প্রত্যক্ষ করেছে ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারমূল্য।
ডিএসই তথ্যসূত্রে, বৃহস্পতিবার ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারমূল্য বেড়েছে ১০ শতাংশ। শেয়ারপ্রতি মূল্য ৪৪.৩০ টাকা নিয়ে লেনদেন শুরু হলেও, কার্যদিবসের সমাপনী মূল্য দাঁড়ায় ৪৮.৭০ টাকায়।
সফটব্যাংকের পরিচিতি:
১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত সফটব্যাংক গ্রুপ কর্পোরেশন জাপানের একটি বহুজাতিক সামষ্টিক হোল্ডিং কোম্পানি। এর সদর দপ্তর জাপানের রাজধানী টোকিওর মিনাতো-তে। তাদের ব্যবসা মূলত বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা।
গ্রুপটি প্রধানত প্রযুক্তি, জ্বালানি এবং আর্থিক খাতের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল- ভিশন ফান্ডও এই গ্রুপের আওতাধীন। তহবিলটির মোট মূলধন ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কৌপ্যাঙ ইনকোর্পোরেশন ও ডিডি গ্লোবাল ইঙ্কের বাজারমূল্য কমায় সফটব্যাংকের ভিশন ফান্ড ইউনিট রেকর্ড পরিমাণ লোকসানের কথা জানিয়েছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে এই লোকসানের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৮২ হাজার কোটি ইয়েন বা ৭৩০ কোটি ডলার। যা ফান্ডটির মহামারি পূর্ব সময়ের ৭৮ হাজার ৮৬০ কোটি ইয়েন লোকসানের চেয়েও বেশি।
ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসময়ে টোকিওভিত্তিক কোম্পানিটির নেট লোকসান ছিল ৩৯ হাজার ৭৯০ কোটি ইয়েন।
তারপরও চলতি বছর স্টার্টআপ বা নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগের গতি বাড়িয়েছেন সফটব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মাসাওশি সন। ফলে মাত্র নয় মাসে ভিশন ফান্ড-২ এর বিনিয়োগ লাভকারী কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে পাঁচগুণ।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটি স্টার্টআপগুলোয় ১৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে এক বৈশ্বিক রেকর্ড করেছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্যিক তথ্য বিশ্লেষক ফার্ম- সিবি ইনসাইটস। একইসঙ্গে, চলতি বছরের শুরুতে ভিশন ফান্ড-২ এক হাজার কোটি ডলার মূলধন নিয়ে বিনিয়োগ শুরু করলেও, সেখানে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর ফলে জুন নাগাদ এটির মোট পুঁজি ৪ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছায়। বিলিয়নিয়ার মাসাওশি সন এই তহবিলে নিজের পকেট থেকেও ২৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন।