বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যে তীব্র মূল্যস্ফীতির নেপথ্য পটভূমি
ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ দরস্ফীতি এখন সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ইউএন ফাও। প্রধান প্রধান খাদ্য পণ্যের দাম পর্যবেক্ষণ করে বিশ্ব সংস্থাটি।
ফাও- এর ফুড প্রাইস ইনডেক্স সূচক অনুসারে, গত মে মাসের পর দুনিয়াজুড়ে নানা প্রকার শস্য, ভেজিটেবল অয়েল, মাংস, ডেইরি পণ্য ও চিনির দাম গত মে মাসে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র শিকাগো মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জে সয়াবিন তেলের দাম এসময় এক বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়। তিন-চতুর্থাংশ বেড়েছে মাংস ও ইথানলের দাম।
উচ্চগতির এ দরস্ফীতিতে প্রভাবিত হয়েছে ভুট্টা, পাম তেল, কফি, চিনিসহ আরও অনেক পণ্যের বাজারদর। তার সঙ্গে আবার বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য পরিবহনের খরচও লাগামহীন ভাবে বাড়ছেই।
এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে শস্য বহনে নিয়োজিত জাহাজের ভাড়া পর্যবেক্ষণকারী সূচক বাল্টিক হ্যান্ডিসাইজ ইনডেক্স অনুসারে, বর্তমানে ফ্রেইটার খরচ ২০০৮ সালে সর্বশেষ যে ব্যাপকতা দেখা দিয়েছিল সে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
খাদ্যের দাম সব সময়ই চক্রাকারে বেড়েছে। মে'র শুরু থেকে কৃষি পণ্যের অধিকাংশ সূচক রয়েছে সর্বোচ্চ অবস্থানে। এমনকি গত মাসে ফাও- এর সূচকও সামান্যই কমেছে সার্বিক বিচারে। তবে টানা এক বছর ধারাবাহিক বৃদ্ধির পর সামান্য কমাটিকে নগণ্যই বলা চলে।
মহামারি থেকে উত্তরণের পালাবদলের মধ্যে দিয়েছে যাচ্ছে পৃথিবী, এই অবস্থায় খাদ্য সরবরাহে অনিশ্চয়তা ও সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা সহজে দূর হবে না বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থনীতি সচল হওয়ায় চীনে আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমিষ ভোজের চাহিদাও বেড়ে চলেছে। তার আগে দেশটির স্থানীয় কৃষি খাতে আফ্রিকান সোয়াইন ফিভার হানা দেওয়ায় অনেক শূকরের পাল ধ্বংস করা হয়, যেকারণে মাংসের দামও রাতারাতি কমার কোনো কারণ নেই। আর যেহেতু চীন বড় ভোক্তা, তাই অন্যান্য দেশ থেকেও বিপুল গবাদিপশু ও হিমায়িত মাংস চীনে রপ্তানি করা হয়। এ চাহিদা বিশ্ববাজারেও সঙ্গতকারণেই মাংসের দামে প্রভাব ফেলছে।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হচ্ছে, খাদ্যের সামান্যতম মূল্যস্ফীতি সম্পূর্ণ অনাহার থেকে মাত্র কয়েক গ্রাস দূরে থাকা বিশ্বের কোটি কোটি দরিদ্রতর মানুষের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক তথ্য ও সংবাদ পরিবেশক সংস্থা ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখকরা মূল কয়েকটি পণ্যে দর বৃদ্ধির প্রভাবকে যেভাবে তুলে ধরছেন, তা এখানে আলোচনা করা হলো;
রান্নার তেল:
দেশজ কৃষি উৎপাদনের চাইতে সম্পূর্ণভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল ভোজ্য তেলের ভিত্তিতে একটি বিশাল দেশে নিজস্ব রন্ধনশৈলীর বিকাশ অতি-বিরল হলেও, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায় তা বাস্তবতা। ভারতীয় রন্ধনশৈলীতে পরোটা, সমুচা বা দোসার মতো অজস্র খাবার প্রস্তুতে ভেজিটেবল অয়েল ব্যবহৃত হয়, যা দেশটিকে তরল উদ্ভিজ্জ চর্বির বৃহত্তম আমদানিকারকে পরিণত করেছে।
অস্বাস্থ্যকর এ নির্ভরতার কারণে গত বছর জুড়েই প্রভাবিত হয়েছেন ভারতীয়রা। এসময় আমদানিকৃত তেলের দাম বাড়ার ফলে স্থানীয় কৃষির পণ্য- সরিষা, তিসি ও নারিকেল তেলের চাহিদা ও দাম নাটকীয় হারে বাড়ে।
ভারতে ভোজ্য তেলের প্রধান উৎস; ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে আনা পাম তেল এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সয়াবিন। আবার সুর্যমুখী তেলের চাহিদা পূরণ করে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আমদানি। এসব কটি বিদেশি তেল ভারতীয় বাজারে সব মিলিয়ে ৪৪ শতাংশ দরস্ফীতি লাভ করে।
দর বৃদ্ধির পেছনে প্রধান অনুঘটক ছিল; মালয়েশিয়ায় রপ্তানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে স্থানীয় পর্যায়ে বায়োফুয়েল উৎপাদনে পাম তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি, ব্রাজিলে শুষ্ক আবহাওয়া এবং আর্জেন্টিনায় বন্দর কর্মীদের ধর্মঘটের মতো কিছু ঘটনা। এসব ঘটনাপ্রবাহ টানা দ্বিতীয় বছরের মতো ভারতকে পুষ্টি সংকটের হুমকিতে ফেলেছে। ভারতে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিরামিষাশী যারা উদ্ভিজ্জ তেল ও চর্বির ওপর প্রোটিন চাহিদা পূরণে নির্ভরশীল। জাতীয় লকডাউনে আয় হারিয়ে গেল বছর দরিদ্ররা খাদ্য গ্রহণও কমান, কমান আমিষ ক্রয়ের খরচ। তার ওপর এমন উচ্চমূল্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বহুলাংশে কমিয়ে দিচ্ছে।
নয়াদিল্লির একটি খাদ্য বাণিজ্য পরামর্শক সংস্থার বিশেষজ্ঞ মনু কৌশিক বলেন, দাম বাড়ায় ভারতীয় কৃষকরা স্থানীয় ফসল সরিষা ও চীনেবাদাম উৎপাদনে ঝুঁকেছেন। তবে চলতি বছর সয়াবিন বীজের দামও অত্যধিক বেশি হওয়ার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে এর উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।
তবে ভারতের ৭০ শতাংশ ভোজ্য তেল চাহিদা আমদানিকৃত তেল পূরণ করে থাকে, তাই দাম বৃদ্ধির পর সরকার গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমদানি ব্যয় কমাতে উদ্যোগী হয়েছে। এ উদ্যোগ বাজারে তেমন প্রভাব ফেলবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এনিয়ে ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক অ্যান্ডি মুখার্জি মন্তব্য করেন, "খাদ্যই হলো শক্তি ও প্রভাবের উৎস। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার বিদেশে উৎপাদিত ভোজ্য তেল নির্ভরতা মহামারি কালে ভারতের দরিদ্রদের ওপর আঘাত হানছে। কৃষক থেকে শুরু করে শহুরে ক্রেতা গোষ্ঠী কেউই এর প্রভাবমুক্ত নন।"
ভুট্টা:
আধুনিক যুগে আমরা যে পরিমাণ খাদ্য খাই শুধু তার ভিত্তিতেই বাজারদর নির্ধারিত হয় না। যেমন ভুট্টার রয়েছে হাজারো অন্যান্য ব্যবহার ও উপযোগ। যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত ভুট্টার মাত্র এক-তৃতীয়াংশই সিরিয়াল, সুইটকর্ন, টাকোস বা পপকর্নের মতো নানান রকম খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। যার বিপরীতে জ্বালানি তেলের সঙ্গে মিশ্রণ দিতে ৪০ শতাংশ ভুট্টাকে ইথানলে পরিণত করা হয়। আর এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় পশুখাদ্য হিসেবে।
এসব কারণে মে মাসে ভুট্টার বৈশ্বিক বাজারসূচক কর্ন ফিউচার্স আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থান লাভ করে। তাছাড়া, গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে এক কোটি টন গ্যাসোলিন উৎপাদন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় শহরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হতে থাকার সুবাদে ২০১৯ সালের পর প্রথমবারের মতো এ মাত্রায় পৌঁছায় জ্বালানিটির উৎপাদন, যা ভুট্টার ব্যবহার বাড়ায়।
পশুখাদ্য উৎপাদনও বেড়েছে ভোক্তাদের মাংসের চাহিদা মেটাতে। এদিক থেকে এগিয়ে রয়েছে চীন। দেশটিতে শূকরের পাল ফের ভারি করতে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। তাছাড়া, গত পাঁচ বছরে বিশ্বে যে চার কোটি ২০ লাখ টনের বেশি ভুট্টা আমদানি বৃদ্ধি পায়, তার অর্ধেকই ছিল চীনের কারণে।
অর্থাৎ, এ বাজারও অচিরেই স্থিতিশীল হচ্ছে না।
বৈশ্বিক চাহিদার এ বাড়বাড়ন্তের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভুট্টা উৎপাদক অঞ্চলে খরা প্রবণতা সরবরাহ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। যেমন; অর্ধ-শতাব্দীকালের সবচেয়ে ভয়াবহ খরায় ভুগছে ব্রাজিল; যেকারণে চলতি বছর মাত্র এক কোটি ১০ লাখ টন উৎপাদনের আভাস দেওয়া হয়েছে। একইদশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে; আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্রেও। মধ্যপশ্চিমাঞ্চলের তীব্র দাবদাহে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেইট প্লেইন অঞ্চলের কর্নবেল্ট খ্যাত সমভূমিতে ভুট্টার আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিচ্ছে।
এনিয়ে ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট ডেভিড ফিকলিং মন্তব্য করেন, "উত্তর আমেরিকার আবাদ যদি বিষুবরেখার দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চলের মতোই কম হয়, তাহলে ভুট্টার বৈশ্বিক ক্রেতাদের চরম দুর্দশার মধ্যে পড়তে হবে।"
ডেইরি পণ্য:
চলতি বছর দুধের মতো ডেইরি পণ্যের হালচাল ভালো নেই। বৈশ্বিক বাজারের একটি আভাস মেলে নিউজিল্যান্ডের গুড়োদুধের নিলামের মাধ্যমে। গত মার্চে প্রতি মেট্রিক টন মূল্য ৪,৩৬৪ ডলারে উন্নীত হয়, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। অন্যান্য অনেক খাদ্যপণ্যের মতোই এক্ষেত্রেও দর বৃদ্ধির মূল কারণ চীনের চাহিদা।
চীনে আয় বৃদ্ধির সুবাদে কেক, পেস্ট্রিসহ গুড়োদুধের চর্বি ও ননী ব্যবহার হয় এমন নানাবিধ পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। শুধু দুধের চাইতে তাই দুদ্ধজাত খাদ্যপণ্যের ভোগ বাড়াটাই এপর্যন্ত দরবৃদ্ধির মূল প্রভাবক।
শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও মোট তরল দুধ উৎপাদনের সাত-ভাগের মাত্র এক ভাগ পান করেন মার্কিনীরা।
তবে গত কয়েক যুগের ব্যাপক শিল্পায়নের প্রভাবে চীনে চারণভূমির সংকট রয়েছে, যা খামারে পশুপালের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রতিবন্ধক। চাহিদার তুলনায় পশুখাদ্যের উৎপাদনেও বিদেশ নির্ভরতা থাকায় ডেইরি শিল্প স্থানীয় চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে।
তার ওপর ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল নাগাদ চীনে গাভীর সংখ্যা ৮০ লাখ থেকে মাত্র ৬২ লাখে নেমে এসেছে। তবে উন্নত জাতের গাভী পালন বাড়ায় দুধের উৎপাদন কোনরকমে চাহিদার কাছাকাছি পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হয়, তবু সেটা ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্যে একেবারেই যথেষ্ট নয়। আর বৈশ্বিক বাজার থেকে এজন্যই বিপুল পরিমাণে গুড়োদুধ কিনছে চীন।
বাড়তি দামের কারণে এটি ডেইরি খামারিদের জন্য সুসংবাদের মতোই শোনায়, তবে বাস্তবতা তেমন নয়। কারণ সরবরাহের মূল দিকটিতে দাম বৃদ্ধির পেছনে মূল অবদান রেখেছে, সয়াবিন ও ভুট্টার মতো পশুখাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার হওয়া শস্যের বাড়তি দাম। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর শত কোটি টনের কিছু বেশি পশুখাদ্য উৎপাদিত হয়, যা চাহিদা ও বিরূপ জলবায়ু- দুইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
ডেভিড ফিকলিং বলেছেন, একারণে চীনের ক্রমশ বেড়ে চলা প্রোটিন চাহিদা যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় থেকে অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া দ্বীপের সয়াশস্য ক্ষেত সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ