ভারতীয়রা কি ব্যাংকের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে?
মহামারির আগে থেকেই বিপুল মন্দ ঋণের ভারে ধুঁকেছে ভারতের সরকারি ব্যাংকগুলো। বেসরকারিখাতের আর্থিক ব্যবসাতেও এমন নৈরাজ্য দেখা গেছে। ফলে গত ১৫ মাস ধরে মন্দ ঋণের পাহাড় কাঁধে লালবাতি জ্বলেছে অনেক ব্যাংকেই।
তাই দেশটির বিশেষজ্ঞরা ভারতীয় ব্যাংকিং খাতের সার্বিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।বিবিসি'র প্রতিবেদক আকৃতি থাপার তার প্রতিবেদনে সাধারণ আমানতকারীদের মনোভাব ও বিশেষজ্ঞ অভিমত তুলে ধরেন।
বেসরকারি মালিকানার লক্ষ্মী বিলাস ব্যাংকের ৫০ বছর বয়সী আমানতকারী মঙ্গিলাল। মুম্বাই নগরীর উপকণ্ঠে তার আছে একটি মনিহারি সামগ্রীর দোকান।
মঙ্গিলালের ভাষায়, ''প্রথমে আমাদের ব্যবসায় কোভিড-১৯ আঘাত হানে। দুই মাস তখন আয় উপার্জন কিছুই ছিল না। কিন্তু, ওই সময়ে ব্যাংকের ব্যবসাতেও নাজেহাল অবস্থা দেখা দেওয়ায় নিজের সঞ্চিত অর্থ তুলে যে খরচ করব, সেই সুযোগ ছিল না। বন্ধ ছিল দৈনন্দিন নিয়মিত লেনদেন। কর্মচারীদের বেতন দেওয়া নিয়েই মহাবিপদে পড়েছিলাম।
মহামারির মধ্যে যখন সঞ্চিত অর্থ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখনই এমন ভোগান্তির শিকার হন লাখো গ্রাহক।
ঐতিহ্যগতভাবে, সঞ্চয়ী স্কিমে আকর্ষণীয় সুদহার এবং বাড়ির কাছাকাছি শাখা থাকার সুবিধা এই দুটি বিষয় বিবেচনায় ভারতীয়রা ব্যাংক নির্বাচন করে থাকেন। সেইসব দিক থেকে মঙ্গিলালের সিদ্ধান্ত ঠিকই ছিল।
কিন্তু, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক- রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ঋণ সঞ্চালনের অব্যস্থাপনা ও মন্দ ঋণের চাপে ধুঁকতে থাকা ৯৪ বছর পুরোনো লক্ষ্মী বিলাস ব্যাংককে গত মাসেই মর্গে পাঠায়। যার আওতায় এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে ৩৩৫ মার্কিন ডলার বা তার বেশি আমানত সঞ্চয়কারীদের অর্থ উত্তোলন।
ফলে এবার সঞ্চয়ের অর্থ পাবেন কিনা- তা নিয়েই দুর্ভাবনায় পড়েছেন মঙ্গিলাল।
তবে তিনি জানান, এবারই প্রথম নয়, আটবছর আগেও একটি সমবায়ী ব্যাংকে দুই বছরের জন্য আটকা পড়েছিল তার আমানত। ওই ব্যাংকটিকেও তখন দেশটির আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রকেরা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এদিকে গত ১৫ মাসে তৃতীয় ব্যাংক হিসাবে এই পরিণতি বরণ করে লক্ষ্মী বিলাস।
এর আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র সমবায় ব্যাংক- পিএমসি একই দশায় পরে। ব্যাংকটির বিরুদ্ধে এখন ভুয়া ঋণ ইস্যু করার অভিযোগে তদন্ত চালাচ্ছে আরবিআই। অভিযোগ এভাবে প্রায় ৬০ কোটি ডলার সমপরিমাণ ঋণ জালিয়াতি করা হয়েছে।
চলতি বছরের মার্চে ভারতের পঞ্চম বৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক- ইয়েস ব্যাংকও বিধিনিষেধের আওতায় আসে। ওই সময় ব্যাংকটি তাদের মন্দ ঋণের চাপ এড়াতে যথেষ্ট মূলধন সংগ্রহে ব্যর্থ হয়েছিল।
আরবিআই অবশ্য আমানতকারীদের কথা ভেবেই লক্ষ্মী বিলাস ও ইয়েস ব্যাংক দুটিকে দেউলিয়াত্বের হাত থেকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়। ফলে তাদের ব্যবসা অধিগ্রহণ করে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডিবিএস। একীভূতকরণের এই উদ্যোগে নতুন করে বিনিয়োগও আসে।
অবশ্য, তাতে সব আমানতকারীর দুর্ভোগ দূর হয়নি। যেমন এখনও পিএমসি'র আমানতকারীরা কবে তাদের আসল জামানত ফেরত পাবেন সেই আশায় দিন গুণছেন।
তাদেরই একজন হলেন ৫৩ বছরের নারী গৃহশিক্ষক বিদ্যা মেরওয়াদ। পিএমসি বন্ধের ১৪ মাস পর এখন বৃদ্ধা মায়ের জমানো অর্থ ধার করে চলছেন তিনি।
তার স্বামীর একটি অটোরিক্সা মেরামত কোম্পানি আছে। দুজনের উপার্জিত অর্থ দিয়েই তারা পিএমসি'তে সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন। সেই অর্থ আটকে যাওয়ায় এখন অনিশ্চিত তাদের মেয়ের জার্মানিতে পড়াশোনার পরিকল্পনা। অর্থ সঙ্কটে আটকে গেছে ছেলের বিয়ে।
পরিতাপের সুরে বিদ্যা বলেন, 'এক ধাক্কায় আমাদের পুরো জীবনের সঞ্চয় যেন হারিয়ে গেছে। এখন আমরা কীভাবে বাঁচব?'
আরবিআই অবশ্য ধীরে ধীরে আমানতকারীদের অর্থ তুলে নেওয়ার নির্ধারিত মাত্রা বাড়াচ্ছে। কিন্তু, বিদ্যার মতো অনেক বড় আমানতকারীর অভিযোগ সম্পূর্ণ সঞ্চয় উত্তোলনে- তা যথেষ্ট নয়।
এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে ভারতীয় ব্যাংকগুলোর এই ব্যর্থতার নেপথ্য কারণ কী?
উত্তরটাও সহজ। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নেওয়া খেলাপি ঋণের ভার দীর্ঘদিন ধরেই বইছে ভারতের ব্যাংকিং খাত। এই সময়ে তারা প্রায় হাজার হাজার কোটি ডলার মওকুফ করেছে।
অর্থনীতিবিদেরা একে 'ঐতিহ্যগত মন্দ ঋণের সমস্যা' বলে অভিহিত করে বলছেন,ব্যবসায়ীদের মুক্তহস্তে ঋণ দিয়েই ভারতীয় ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের এই পাহাড় জমেছে।
এব্যাপারে আরবিআই- এর প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের অভিমত, ব্যাংকারদের বড় অংকের মুনাফা অর্জনের অতিরিক্ত আশা এবং উৎসাহ আজকের এই অবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী।
ব্যাংকগুলির ধসকে অবশ্যই বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। মহামারির করাল থাবায় সঙ্কুচিত হয়েছে ভারতীয় অর্থনীতি। যেকারণে মন্দ ঋণের পাহাড় আরো বিশাল রূপ নিয়েছে। এমন ব্যাখ্যা দেন ভারতের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (এসবিআই) সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বৃন্দা জায়গীরদার।
''মন্দ ঋণের আরেক কারণ আর্থিক ব্যবসা পরিচালনায় কর্পোরেট গভর্নেন্সের বেহাল দশা, অব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংকগুলোর দুরদর্শীতার অভাব। সকল পর্যায়ে আরো বেশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব,'' তিনি যোগ করেন।
জায়গীরদার আরো বলেন, বেশ কিছু বড় ধরনের আঘাত সত্বেও ভারতের ব্যাংকিং খাত শক্ত মৌল ভিত্তির উপরেই আছে। আর গত কয়েক বছরে অনেক প্রক্রিয়ার জটিলতা দূর করে পরিচালনা পদ্ধতিতে সরলতা আনা হয়েছে। যেমন; ২০১৬ সালে ভারত প্রথমবারের মতো এমন একটি দেউলিয়াত্ব আইন পাস করে যার সহায়তায় পাওনাদার আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ঋণ উদ্ধার করতে পারবে।
কিন্তু, এসব পদক্ষেপ আমানতকারীদের ভীতি দূর করতে পারছে না।
জলজা মেহতা এমন ব্যক্তিদের কাতারেই পড়েন। ইয়েস ব্যাংক ও পিএমসি ব্যাংকে অর্থ জমা রেখেছিলেন এই ব্যবসায়ী নারী। একের পর এক ব্যাংক দুটি বন্ধ হওয়ায় তিনি মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে পড়েন। আর্থিকভাবেও হয় দ্বিগুণ ক্ষতি।
তিনি বলেন, ''ওই ঘটনার পর থেকে ভেবেছি এখন থেকে বাড়িতেই বেশি টাকা-পয়সা রাখব। ছোটখাট সঞ্চয় ব্যাংকে রাখতে পারি। কারণ এই খাতের উপর থেকে আস্থাটাই হারিয়ে ফেলেছি।''
- সূত্র: বিবিসি