ভারতীয় চাল আমদানির সংবাদে ধানের বিক্রি কমেছে
হাটে ধানের যোগান আছে বেশ, দামও স্থিতিশীল। তবুও বেচাকেনা কমেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ধানের হাটে। শতবর্ষী ওই হাটে বর্তমানে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হচ্ছে, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অন্তত ৩০ শতাংশ কম। মূলত বেসরকারিভাবে ভারতীয় চাল আমদানির ফলে বাজারে দেশি চালের দাম কমবে। এজন্য লোকসানের শঙ্কায় কম ধান কিনছেন চালকল মালিকরা। তাদের মতে, ভারতীয় চাল বাজারে এলে ধানের বাজারদর আরও কমবে। একই ধরনের শঙ্কা থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের চালকল মালিকরাও ধান কম কিনছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুগঞ্জের মেঘনা নদীর ভিওসি ঘাটের ধানের হাটটি পূর্বাঞ্চলের ধানের মোকামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ। এই মোকামে প্রতিদিন ভোরে নৌকায় করে ধান নিয়ে আসেন বেপারীরা। এরপর সকাল ৮টা থেকে থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত ধান বেচাকেনা হয় ভিওসি ঘাটের ওই হাটে।
বর্তমানে হাটে বিআর-২৮, বিআর-২৯ ও হীরা ধান বেচাকেনা হচ্ছে। প্রতি মণ বিআর-২৮ জাতের ধান ১,১৬০ থেকে ১,১৭০ টাকা, বিআর-২৯ জাতের ধান ১,১০০ থেকে ১,১২০ টাকা এবং হীরা ধান প্রতি মণ বেচাকেনা হচ্ছে ৯৫০ থেকে ৯৭০ টাকা দরে।
ধানের মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ মণ ধান বেচাকেনা হয় হাটে। আর বাকি সময়গুলোতে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হয় হাটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সকল চালকল মালিকরা হাট থেকে ধান কিনেন। জেলায় তিন শতাধিক চালকল রয়েছে। এর মধ্যে আশুগঞ্জ উপজেলায় আছে অন্তত আড়াইশ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চালকলগুলো থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সবকটি জেলা এবং ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় চাল সরবরাহ করা হয়।
গত আগস্ট মাসের শুরুর দিকেও হাটে প্রতিদিন অন্তত ৫০ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হয়েছে। কিন্তু আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে বেচাকেনা কমতে থাকে। বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মণ ধান বেচাকেনা হচ্ছে। হাটে ভারতীয় চাল আমদানির খবর যাওয়ার পর থেকেই বেচাকেনা কমতে থাকে। সেই সঙ্গে ধানের দামও মণপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে যায়।
চালকল মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে, অটো-রাইসমিলগুলোতে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার মণ ধানের চাহিদা রয়েছে। আর অন্য রাইসমিলগুলোতে প্রতি সপ্তাহে চাহিদা আছে এক হাজার মণ ধানের। কিন্তু ভারতীয় চাল আমদানি খবরে এখন চাহিদা মতো ধান কিনছেন না চালকল মালিকরা। কারণ ধান থেকে চাল তৈরি করতে দ্বিগুণ খরচ পড়ে। সে অনুযায়ী বাজারে চালের দর কম।
কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে ধান নিয়ে আসা বেপারী সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি বিআর-২৯ জাতের ৩০০ বস্তা ধান নিয়ে এসছেন হাটে। কেনা দরের চেয়ে হাটে কম দামে ধান বেচাকেনা হচ্ছে। এতে করে ৩০০ বস্তা ধানে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান হবে তার। ভারত থেকে চাল আসবে- এই খবরে চালকল ব্যবসায়ীরা ধানের দাম কমিয়ে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
আশুগঞ্জ উপজেলার রজনীগন্ধা এগ্রো ফুডের সত্ত্বাধিকারী হাসান ইমরান জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাজারগুলোতে এখনও ভারতীয় চাল ঢুকেনি। ভারতীয় চালের দাম পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত ধানের বাজারে মন্দাভাব কাটবে না। এখন চাহিদার চেয়েও কম ধান কেনা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে আশুগঞ্জ উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হেলাল সিকদার বলেন, "সরকার ১৭ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দিয়েছে বলে শুনেছি। এর ফলে সাধারণ মিল মালিকরা কম ধান কিনছেন। এতে করে বাজারে ধানের দামও কিছুটা কমেছে। মিল মলিকরা ভারতীয় চালের বাজার পর্যবেক্ষণ করতে চাইছেন। ভারতীয় চাল বাজারে আসার পর বাজারদর দেখে যদি তারা মনে করেন যে, দামে খুব বেশি পার্থক্য নেই, তাহলে আবার আগের মতো ধান কিনবেন।"
ভারত থেকে চাল আমদানির খবরে দিনাজপুরে গত ১৫ দিন আগে থেকেই কমতে শুরু করেছে ধানের দাম। গত এক মাস আগের চেয়ে বস্তাপ্রতি কমেছে প্রায় দেড়শ' থেকে দুইশত টাকা পর্যন্ত। ধানের দাম কমে যাওয়ায় কমছে চালের দাম। এতে করে লোকসানের মুখে চালকল মিল মালিকরা।
দিনাজপুরের গোপালগঞ্জ হাট, রানীগঞ্জ হাট, ফার্মেরহাটসহ বিভিন্ন হাটে যেখানে বিআর-২৮ জাতের ধান প্রতি বস্তা প্রতি (৭৫ কেজি) বিক্রি হয়েছে ২,২৫০ থেকে ২,৪০০ টাকা দরে বর্তমানে সেই ধান বিক্রি হচ্ছে ২,১০০ থেকে ২,২০০ টাকা দরে। একইভাব্ বিআর-১৬ জাতের ধান ২,২০০ থেকে ২,৩০০ টাকা থেকে কমে বিক্রি হচ্ছে ২,০০০ থেকে ২,১৫০ টাকায় আর মোটা জাতের (হাইব্রিড) ধান ১,৯০০ থেকে ২,০০০ টাকা থেকে কমে বিক্রি হচ্ছে ১,৮০০ থেকে ১,৯০০ টাকায়। ৩৪ জাতের ধান ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ৩,২০০ থেকে ৩,৩০০ টাকায়। একইভাবে মিনিকেট জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ২,৩০০ থেকে ২,৪০০ টাকায়।
বাহাদুরবাজার চালহাটীর ব্যবসায়ী আমজাদ আলী বলেন, "চালের দাম একটু কমেছে। ভারত থেকে চাল আসার খবরে এটি হয়েছে। তাছাড়া আমি যতদূর জেনেছি ভারতীয় চালের মান খারাপ। তবে কম-বেশির প্রভাবটি ভাল বোঝা যাবে রোববার নাগাদ।"
সদর উপজেলার বালাপাড়া এলাকার ধান-চাল ব্যবসায়ী চিরঞ্জিত বসাক বলেন, "কয়েকদিন আগে ধানের দাম বেড়েছিল, কিন্তু এখন দাম কম।"
সদর উপজেলার কানাইবাড়ী এলাকার ধান-চাল ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বলেন, "প্রতি বস্তায় ধানে দেড় থেকে দুইশ টাকা কমেছে। ধানের দাম কমে যাওয়ায় যে চাল আমি করে রেখেছিলাম এখন তাতে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমার প্রায় দুইশ বস্তা ধানে ৫০ হাজার টাকার লোকসান গুনতে হবে।"
দিনাজপুর চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন বলেন, "ভারত থেকে চাল আসার কারণে ইতোমধ্যেই মিল মালিকরা লোকসানের মধ্যে পড়েছে। বাজারে ধানের দাম কমেছে, ফলে কমছে চালের দামও। দাম কমে যাওয়াতে মিল মালিকরা তাদের উৎপাদিত চাল বিক্রি করতে পারছেন না।"
পাবনায় ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে চাষীরা। ভারত থেকে চাল আমদানীর খবরে মিল মালিকেরা কৃষকের ধান কিনতে অনিহা প্রকাশ করছে। ইতঃপূর্বে মিল মালিকেরা ধান কিনে মজুদ করলেও এখন পাবনার চালকলগুলো সতর্কতার সঙ্গে বাজার পর্বেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা শুধু প্রতিদিনের চাহিদামতো ধান কিনে চাল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানা গেছে, খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুমে পাবনা জেলার নয়টি উপজেলাতে মোট পাঁচ লাখ চুয়ান্ন হাজার ছাব্বিশ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সমপরিমাণ ধান উৎপন্ন হয়েছে। আর এজন্য এক লাখ ৭৮ হাজার ৮৭৬ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছিল জেলার ধান চাষীরা।
পাবনা সদর উপজেলার আটঘড়িয়া গ্রামের ধান চাষী বিপ্লব সেন জানান, পাবনার টেবুনিয়া দাশুরিয়াসহ বড় বড় হাটে কৃষকেরা ধান বিক্রি করতে গিয়ে দাম কম শুনে বিপাকে পড়ে গেছেন। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাট বাজারে প্রকার ভেদে নয় শত থেকে এ হাজার তিনশত টাকা দরে ধান কেনা-বেচা হচ্ছে।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার বড়ইচড়া এলকার বিশ্বাস অটো রাইস মিলের মালিক শামসুল আলম জানান, ভারত থেকে চাল আমদানির খবরে অস্থিতিশীল বাজার থেকে ধান খরিদ করে সাহস পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আশঙ্কা করছেন, যে কোনো সময় চালের বাজার আরো কমে যেতে পারে। ফলে বেশি দামে ধান খরিদ করলে লোকসানের মুখ দেখতে হতে পারে। ফলে দৈনন্দিন কেনা-বেচার মাধ্যমে শুধু মিলের চাহিদা মতো ধান কিনে চাল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দিনাজপুর ও পাবনা প্রতিনিধি