ভোক্তা ব্যয়ের শক্তিশালী পুনরুত্থান
মহামারির প্রভাবে অনেকেই শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। তবে সম্প্রতি ভোক্তারা আবারও আগের মতো খরচ করা শুরু করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন সূচক ও লেনদেনের চিত্রে এমনটাই প্রতীয়মান হয়।
বেড়েছে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন। সঞ্চয়ের ধরনও পরিবর্তিত হয়েছে, ভোক্তাদের খরচের ধরনের পরিবর্তনের বড় নির্দেশক এটি।
ক্রেডিট কার্ডের লেনদেনের পরিমাণ ইতোমধ্যে প্রাক-মহামারির মাত্রা অতিক্রম করেছে, গত বছরের ডিসেম্বরে এ পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
সিটি ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনের প্রধান আরিফুর রহমান বলেন, চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করায় মানুষ বাইরে বের হচ্ছে এটি এটি ভালো লক্ষণ।
তিনি জানান, ভোক্তারা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছেন এবং স্থানীয় পর্যটন গন্তব্যে ভ্রমণের জন্য ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করছেন।
তিনি আরও বলেন, "করোনাভাইরাসের নতুন ওয়েভ উদ্বেগজনক, ভোক্তাদের এই আচরণ (লেনদেনের) কতদিন টিকে থাকবে তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না আমরা।"
মহামারির কারণে ভোক্তারা অনলাইন কেনাকাটার দিকে ঝুঁকেছেন, ই-কমার্সে লেনদেনের বর্তমান চিত্রও ভোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, প্রাক-মহামারি পর্যায়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি লেনদেন হয়েছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে। গত বছরের ডিসেম্বরে যার পরিমাণ ছিল রেকর্ড সংখ্যক ৬০০ কোটি টাকা।
ভোক্তাদের খরচের প্রবণতা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসার ফলে এ বছরের জানুয়ারিতে মহামারিকালীন সঞ্চয়ে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গত বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতাও বাড়ে।
গত বছরের ডিসেম্বরে রেকর্ড পরিমাণ সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৭২ কোটি টাকা বৃদ্ধির পর জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর ডিমান্ড ডিপোজিট হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যে সব অ্যাকাউন্ট থেকে গ্রাহক তার অর্থ যে কোন সময়ে উত্তোলন করতে পারেন, সে সব অ্যাকাউন্ট থেকে জানুয়ারিতে গ্রাহকদের ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ উত্তোলনের হার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানুয়ারিতে এর আগের মাসের চেয়ে ডিমান্ড ডিপোজিট ৪ শতাংশ হ্রাস পেলেও বিপরীত প্রবণতা দেখা গেছে টাইম ডিপোজিটে। নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা মহামারীর সময় চাকুরি হারিয়েছেন ও যাদের আয় হ্রাস পেয়েছে তারা পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছেন।
টার্ম ডিপোজিট - যে অ্যাকাউন্টে সঞ্চয়কারী কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত একটি পূর্বনির্ধারিত সময়ের জন্য টাকা সঞ্চয় করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুসারে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মাত্র এক মাসে তা ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সঞ্চয় হ্রাস অতিরিক্ত তারল্যের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা মন্থর করেছে। ব্যাংকিং খাতে মোট তারল্য জানুয়ারিতে ২ ট্রিলিয়ন টাকায় স্থির ছিল, যার পরিমাণ গত বছরের ডিসেম্বরেও বজায় ছিল।
ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, "এটি একটি সাধারণ বিষয়, অনিশ্চয়তার সময় মানুষ বেশি সঞ্চয় করে। মহামারির সংকটের মধ্যে ডিমান্ড ডিপোজিটের উত্থানে তা প্রতিফলিত হয়েছে,
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে ভোক্তারা বেশি খরচ শুরু করেছে, তাদের অভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ভীড়ই ভোক্তাদের বেশি খরচের প্রবণতার প্রতিফলন। ব্যাংকে ঋণের চাহিদাও আগের চেয়ে বেড়েছে।
সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের সিনিয়র ম্যানেজার (মার্কেটিং কমিউনিকেশন) রাজিউর রহমান বলেন, , "ভোক্তাদের পণ্যের অগ্রাধিকারও বদলেছে। আমরা ভোক্তাদের স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতার সাথে সম্পর্কিত পণ্যের চাহিদার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। এছাড়া, ল্যাপটপের মতো বিভিন্ন তথ্য-প্রযুক্তি পণ্যের চাহিদাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে,"
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কেনাকাটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো বেশিরভাগ মানুষের সংকোচ থাকায় কেনাকাটায় প্রাক-মহামারির পরিস্থিতি ফিরে আসেনি।
তিনি জানান, কেউ আগে কোনো পণ্যের দুই ইউনিট কিনলে বর্তমানে এক ইউনিট কিনছেন, বা একান্তই প্রয়োজন না হলে কিনছেন না। দেশজুড়ে বেশিরভাগ পরিবারের আয় কমেছে মহামারির মধ্যে, অনেকে এখনো সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেননি।
প্রাক-মহামারি পর্যায়ে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, "তবে, ভ্যাকসিন চলে আসায় প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হচ্ছে। আসন্ন রমজান ও ঈদকে ঘিরে এ খাত আবারও স্বমহিমায় ফিরে আসবে,"
মুদ্রাস্ফীতির তথ্যেও ভোক্তাদের চাহিদা বৃদ্ধির ব্যাপারটি লক্ষ করা যায়, কারণ ভোক্তাদের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতির শতকরা হার ৫ দশমিক ৩২ এ পৌঁছেছে, খাদ্য ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির আগে গত জানুয়ারিতেও এ হার ছিল ৫ দশমিক ০২ শতাংশ।
আসন্ন দিনগুলোতে মুদ্রাস্ফীতির চাপের ব্যাপারে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে জানিয়ে বলা হয়, ফলস্বরূপ সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশও কিছুটা চাপের মুখে পড়বে।
২০২০ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত প্রবল সংকটে পড়লেও এবছরের জানুয়ারি মাসে এর আগের মাসের চেয়ে প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, স্থানীয় বাজারে ব্যয় বৃদ্ধি এতে ভূমিকা রেখেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি খরচ ছিল ২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার, জানুয়ারির শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
অন্য কথায়, শুধু জানুয়ারি মাসেই আমদানি খরচ ৬ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ভোগ্যপণ্য আমদানির পরিমাণ ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়েছে, এর বেশিরভাগই বেড়েছে জানুয়ারি মাসে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর সাম্প্রতিক এক জরিপে জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে শক্তিশালী ব্যবসায়িক পুনরুত্থানের চিত্র উঠে এসেছে, যা ভোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধিই নির্দেশ করে।
জরিপে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়কালে প্রায় ১৬ শতাংশ উদ্যোক্তা শক্তিশালী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, যা অক্টোবর-ডিসেম্বরে ছিল মাত্র ৪ শতাংশ।
উপরন্তু, প্রায় ১৫ শতাংশ উদ্যোক্তা এই ত্রৈমাসিকে দুর্বল পুনরুদ্ধারের আশা প্রকাশ করেছেন, যা গত ত্রৈমাসিকে ২৬ শতাংশ ছিল।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
বিশ্বজুড়ে ধনীরা মহামারির সময়ে সঞ্চয়ের পাহাড় গড়ায় ভোক্তা নেতৃত্বাধীন প্রবৃদ্ধির আশায় আছে বৈশ্বিক অর্থনীতি।
২১টি ধনী দেশের কর পরবর্তী আয় এবং ভোক্তাদের ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্যের বিবেচনায় ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছে লন্ডন ভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য ইকোনমিস্ট। এতে দেখা গেছে, পরিবারগুলো ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সঞ্চয় করেছে।
কিছু জায়গায় আবার পরিবারগুলো অন্যদের তুলনায় বেশি নগদ অর্থ সঞ্চয় করেছে।
অতিরিক্ত সঞ্চয় শীঘ্রই দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ১ দশমিক ট্রিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনার প্রভাবও আছে এতে।
এদিকে, জেপি মরগান চেজ নামে একটি ব্যাংকের গবেষণা বলছে, অনেক ধনী দেশে ভোক্তাদের চাহিদা ও ব্যয় শীঘ্রই প্রাক-মহামারি পর্যায়ে পৌঁছাবে, যা শক্তিশালী বৈশ্বিক পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখবে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, পুনরায় সম্পূর্ণভাবে সবকিছু খুলে দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত সঞ্চয় ব্যয় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে দুই শতাংশ পয়েন্ট যোগ করবে। এটি উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান উভয় ক্ষেত্রেই মোটামুটি দ্রুত পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়।
মহামারির সময় স্থবির হয়ে পড়া গৃহস্থালি চাহিদা পুনরায় বাড়তে শুরু করায় ২০২১ সালে জি-২০ গ্রুপের দেশগুলোর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে সংশোধিত নতুন পূর্বাভাসে জানিয়েছে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Return of the great consumers