মধু-মোম সংগ্রহে পড়েনি করোনার প্রভাব, ২০০ টন মধু বাজারে
করোনাকালে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহে কোনো প্রভাব পড়েনি। পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে চলতি বছর ২০০ টন মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া সংগ্রহ হয়েছে ৬০ টন মোম। সুন্দরবন থেকে আহরিত মধু এখন দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বাজারের চাহিদা মেটাচ্ছে।
সুন্দরবনে সাধারণত খলিশা, বাইন ও গরান ফুলের মধু সংগ্রহ করা হয়। এখান থেকে আহরিত মধু ও মোম থেকে সংগৃহীত রাজস্বের পরিমাণ ২১ লাখ টাকা।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশনের এসও সুলতান আহমেদ জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এলাকা থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করা হয়েছে যথাক্রমে ২০০, ৬৫ ও ৬০.১৯৫ টন। মধু সংগ্রহে সরকার ১৫ লাখ চার হাজার ৮৭৫ টাকা এবং মোমে ৬ লাখ ১ হাজার ৮২৫ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে।
তিনি আরও জানান, পহেলা এপ্রিল থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের মৌসুম। এ বছর বন বিভাগ থেকে পাস নিয়ে ৫৭৩টি বোটে মোট ৪০১৩ জন মৌয়াল মধু সংগ্রহে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন।
জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কষ্ট আর পরিশ্রম করে বন থেকে মধু সংগ্রহ করলেও তার প্রকৃত মুনাফা ভোগ করতে পারেন না মৌয়ালরা। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের মৌয়াল আব্দুর রশিদ জানান, 'মহাজনের কাছ থেকে লাখ টাকা সুদ নিয়ে নৌকা ভাড়া করে আমরা একটি দল বনে প্রবেশ করি। এরপর সুন্দরবন থেকে আহরিত মধু পাইকারি দরে কিনে নেন মহাজনেরা। তারা মৌয়ালদের কাছ থেকে প্রতি কেজি খলিশা ফুলের মধু ৩৫০-৩৮০ টাকায় আর বাইন, গিবো ও গরান ফুলের মধু কেনেন ৩০০-৩৫০ টাকায়। অথচ এই মধু মহাজনেরা বাজারে বিক্রি করেন ৭০০-৮০০ থেকে হাজার টাকা দরে।'
শ্যামনগর সদরের মধু বিক্রেতা শাহিনুর রহমান সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করেন। শ্যামনগর বাজারে তার মধুর ক্যান্টিন নামে একটি দোকান রয়েছে।
মধু সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের পদ্ধতি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, 'মধু সংগ্রহ করার মৌসুমে যখন মৌয়ালরা বন বিভাগ থেকে পাস নিয়ে বনে প্রবেশ করেন, তখন দাদনে আমি তাদের টাকা দেই। মধু সংগ্রহ করে ফিরলে আসার পর আহরিত মধু ভাগাভাগি হয়। একটি নৌকায় দশজন বনে যাই এ কাজে। ফিরে আসার পর মধু ভাগ হয় ১১ ভাগে। দাদনে টাকা দেওয়ার কারণে আমি এক ভাগ মধু পাই। এছাড়া আহরিত বাকি দশভাগের মধুও আমি নগদ টাকা দিয়ে মৌয়ালদের কাছ থেকে কিনে নেই।'
'মধু বিক্রি হয় অর্ডারের মাধ্যমে,' জানিয়ে তিনি বলেন, 'সুন্দরবনের খাঁটি এই মধুর চাহিদা ব্যাপক। মধু সংগ্রহের পর তা অনলাইন অর্ডার ও মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি। কুরিয়ারের মাধ্যমে মধু পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া স্থানীয় কিছু ক্রেতাও এই মধু কিনে নেন।'
'আমি প্রতিদিন ৪০-৬০ কেজি মধু বিক্রি করছি। সুন্দরবনের খলিশা ফুলের মধু প্রতি কেজি বিক্রি করছি ৭০০ টাকায়, বাইন ফুলের মধু ৬০০ আর গরান ফুলের মধু ৫৫০ টাকায়। এছাড়া গোপালগঞ্জ জেলা থেকে সংগ্রহকৃত কালোজিরা ফুলের মধু পাইকারি বিক্রি করছি ৭৫০ টাকায়,' বলেন তিনি।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা আবুল হাসান জানান, সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার বনজীবী রয়েছেন। এদের মধ্যে মৌয়ালের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি।
এ কাজে সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহের জন্য বনে প্রবেশের অনুমতি দেন। তাছাড়া এ বছর মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণ কিংবা অন্য কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি মৌয়ালদের। তবে মাছ ধরতে গিয়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জে পাঁচ জেলে পানিতে ডুবে বা স্ট্রোক জনিত কারণে মারা গেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তা সালেহ মোঃ আব্দুল্লাহ জানান, সুন্দরবন থেকে মধু ও মোম সংগ্রহের পর বিভিন্ন কোম্পানি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা কিনে নেন। তাছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতেও কিছু মধু চলে যায়। এক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে মধু বিক্রির কোনো নির্ধারিত মূল্য না থাকায় ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো মূল্য নির্ধারণ করে মধু সংগ্রহ ও বিক্রয়ের সুযোগ নিচ্ছেন।
মৌয়ালদের ন্যায্যও পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে মধুর মূল্য নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, "বাজারে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিজেদের মধুকে খাঁটি বলে ক্রেতাদের কাছে ভেজাল মধু বিক্রি করার সুযোগ নিচ্ছেন। মধু খাঁটি কি না তা বিএসটিআই'র মাধ্যমে পরীক্ষা করে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।"