মহামারিকালে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি কমেছে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ: জরিপ
করোনাকালে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি কমেছে ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম আট হাজার টাকার মজুরি এখনো ২৩ শতাংশ শ্রমিক পায় না। তবে ওভারটাইম মিলিয়ে এ খাতের একজন শ্রমিকের বর্তমানে গড় আয় ১১ হাজার টাকার ওপরে। অন্যদিকে এখনও ৯০ শতাংশ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে রয়ে গেছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেয়ার বাংলাদেশ এর এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার এক বহু পরামর্শমূলক সভায় জরিপে প্রাপ্ত খসড়া তথ্য তুলে ধরা হয়।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিএস) এর সিনিয়র ফেলো মাহিন সুলতানের সঞ্চালনায় এ সময় সংসদ সদস্য শিরিন আক্তার ছাড়াও শ্রমিক ও বিভিন্ন এনজিও'র প্রতিনিধিরা খসড়া জরিপের ওপর তাদের মতামত তুলে ধরেন।
সভায় জরিপে প্রাপ্ত খসড়া ফলাফল তুলে ধরেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজ আহমেদ।
জরিপে ট্রেড ইউনিয়ন প্রত্যাশিত মাত্রায় না হওয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে শ্রমিকদের হয়রানির বিষযটিও উঠে আসে। এসব চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১৯০তম কনভেনশন বাস্তবায়ন করার দাবিও উঠে আসে সভায়।
চলতি বছর ৩৯০ জন গামেন্টস শ্রমিকের উপর জরিপের ভিত্তিতে আলোচ্য ফলাফল উঠে আসে। সভা শেষে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড- এর সঙ্গে আলাপকালে সভার আয়োজক কেয়ার বাংলাদেশ এর প্রতিনিধি বাবুল আজাদ বলেন, সোমবারের এ সভা ছিলো মূলত স্টেকহোল্ডার ভ্যালিডেশন। জরিপ প্রতিবেদনটি চূড়ান্তভাবে উপস্থাপনের আগে এই সভার সুপারিশগুলোও প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
খসড়া জরিপ প্রতিবেদেনে বলা হয়, এখনো ২২ শতাংশের বেশি গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। এর বদলে অনেক কারখানা কেবল আইডি কার্ড দিচ্ছে। ১০ শতাংশ কারখানায় তাও দেওয়া হচ্ছে না। অথচ শ্রম আইন অনুযাযী, চাকরি শুরুর আগেই নিয়োগপত্র দেওয়ার কথা। কিন্তু, যারা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাচ্ছেন, তাদেরও চাকরি শুরুর পর ক্ষেত্র-বিশেষে একবছর লেগে যাচ্ছে।
কারখানায় নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের আলাদা আলাদা সার্ভিস বুক থাকতে হয় এবং এতে কোন তথ্য যুক্ত করতে হলে শ্রমিকের জানাতে হবে। কিন্তু, ৪০ শতাংশ শ্রমিক জানে না, সার্ভিস বুকে কী তথ্য রয়েছে এবং সেখানে যে তাদের স্বাক্ষর থাকতে হয়- তাও জানে না।
জরিপে বলা হয়, ৭৮ শতাংশ শ্রমিক সপ্তাহিক ছুটি নিতে পারেন না। অন্যদিকে, অর্ডার শিপমেন্ট কিংবা উৎসবের মত পরিস্থিতির কারণে প্রায় ৭৯ শতাংশ শ্রমিক সাপ্তাহিক ছুটি থেকে বঞ্চিত হন। ছুটি চাইলে অবাঞ্চিত মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে জানিয়েছেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ। অন্যদিকে, ছুটি চাইলে চাকরি হারানোর ভয়ের কথা জানিয়েছেন এক-চতূর্থাংশ শ্রমিক।
অবশ্য জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছেন। এর মধ্যে ৯৪ শতাংশ কমপ্লায়েন্ট কারখানার শ্রমিক।
জরিপে উঠে এসেছে শ্রমিকের শারীরিক হয়রানির চেয়ে মানসিক নিগ্রহের বিষয়টি। এর মধ্যে রয়েছে অন্যভাবে তাকানো, পোশাক নিয়ে কথা বলা এবং ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা – যার বেশিরভাগই ঘটে প্রোডাকশন ফ্লোরে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭৪ শতাংশই জানিয়েছেন, চাকরি হারানোর ভয়ে তারা এ বিষয়ে কোন অভিযোগ করেন না। তবে যেসব কারখানায় অ্যান্টি-হ্যারাসমেন্ট কমিটি রয়েছে, সেখানে এ ধরনের হয়রানি কমেছে ৬১ শতাংশ।
বর্তমানে নতুন করে সংশোধন হতে যাওয়া শ্রম আইনে শ্রমিকবান্ধব ওয়ার্কপ্লেস তৈরির ক্ষেত্রে এখন থেকেই শ্রমিক নেতাদের উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ উঠে আসে আলোচনায়। আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য ও শ্রম অধিকার কর্মী শিরিন আক্তার তার বক্তব্যে, যেসব ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে, সেগুলোকে কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব দেন।
কর্মজীবী নারী সংস্থার সভাপতি প্রতিমা পল মজুমদার বলেন, এতকিছুর মধ্যেও গত কয়েক বছরে আমাদের তৈরি পোশাক খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের সেরা ১০টি গ্রিন কারখানার বেশিরভাগই বাংলাদেশে। তিনি বলেন, রপ্তানি আদেশ বাড়লেও দাম পাচ্ছি না। পৃথিবীতে সব কিছুর দাম বেড়েছে, কিন্তু পোশাকের দাম বাড়েনি। এক্ষেত্রে, ট্রেড ইউনিয়নগুলো কিছু করতে পারে কিনা- সে বিষয়ে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি।
শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার কোভিডকালে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক চাকরি হারিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরলেও তাদের জন্য কোন ধরনের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় নিজের হতাশার কথা জানান। তিনি বলেন, বর্তমান শ্রম আইন শ্রমিকের জন্য নয়, মালিকের জন্য হয়ে গেছে। এই আইন হতে হবে উভয়ের জন্য।
তিনি বলেন, আইএলও কনভেনশনের ১৯০ ধারা বাস্তবায়নের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত সময় আর আসবে না।
অবশ্য বক্তাদের মধ্যে কেউ কেউ এত বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৩৯০ জনকে নমুনা জনসংখ্যা হিসেবে বাছাই করে জরিপ করায়- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।