মহামারির ধাক্কায় বেড়েছে প্লটের বিক্রি
রাজধানীর উত্তরা-তৃতীয় পর্ব আবাসিক প্রকল্পে ২০১১ সালে ৫ কাঠার একটি প্লট কেনেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হাসান সুমন। ২০১৬ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় ফিরে শুরু করেন ঠিকাদারি ও পরিবহন ব্যবসা।
গত বছর কোভিড-১৯ শুরু হলে ব্যবসায় মন্দা নেমে আসে। ব্যবসা ধরে রাখতে এবং সংসার পরিচালনার জন্য বাধ্য হয়ে গত বছরের শেষ দিকে উত্তরা-তৃতীয় পর্ব আবাসিক প্রকল্পে কেনা প্লটটি বিক্রয় করে দেন তিনি।
হাসান সুমন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০১৬ সালে রোড এন্ড হাইওয়ের ঠিকাদারি, সেতু নির্মাণ ও পণ্য পরিবহনের জন্য দুইটি কাভার্ড ভ্যান কিনে ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসা ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু কোভিড শুরু হলে শ্রমিক না পাওয়ায়সহ নানা কারণে চলমান ৬ টি প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সরকারের কাছ থেকে কোনো বিল উঠাতে পারিনি। আবার পণ্য পরিবহনে যে দুইটি ভ্যান কিনেছিলাম, সেগুলোও বন্ধ করে দিতে হয়।'
তিনি বলেন, 'বেশ অনেক টাকা ঋণ হয়েছিল। বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী ও সরঞ্জাম কেনার বকেয়া টাকা পরিশোধ করে হাতে কোনো টাকা ছিল না। আবার বিলও পাইনি। ব্যাংকে ঋণের আবেদন করলেও সাড়া না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে এক কোটি ১ কোটি ১৫ লাখ টাকায় প্লটটি বিক্রয় করে দেই।
শুধু হাসান সুমন নয়। কোভিডের ধাক্কায় সারাদেশে এরকম লাখো প্লট মালিক তাদের স্বপ্নের বাড়ি নির্মানের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে কেনা লাখো প্লট বিক্রয় করে ব্যবসা বা জীবন-সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়েছেন।
সরকারের নিবন্ধন অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার আবাসিক প্লট ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল (সাফ-কবলা দলিল) নিবন্ধন হয়েছে। আবাসিক প্লটগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩০০ টি আবাসিক প্লট হস্তান্তরের দলিল (সাফ-কবলা দলিল) নিবন্ধন হয়েছে। আবাসিক প্লটগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার আবাসিক প্লট ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল (সাফ-কবলা দলিল) নিবন্ধন হয়েছে। আবাসিক প্লটগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ৩৮হাজার কোটি টাকা।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক নিপেন্দ্র নাথ শিকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যেসব আবাসিক প্লট বিক্রয়ের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রয় করা, অর্থাৎ যিনি এইবার বিক্রয় করলেন, তিনি এর আগে প্রকল্পের কাছ থেকে ওই প্লটটি কিনেছিলেন।
তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পগুলো গড়ে ওঠে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর সংশ্লিষ্ট শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ/সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অনুমতি নিয়ে। এসব আবাসিক প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ ও ক্রেতার মধ্যে প্রথমবার প্লট হস্তান্তর দলিল সম্পন্ন হয়।
যেসব দলিলে নিবন্ধন হয়েছে, সেগুলো সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্ট শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি বা পৌরসভার কাগজপত্র জমা দিতে হয় দলিলের সময়। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট আবাসন প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের এনওসি বাধ্যতামূলক। এসব কিছু বিবেচনায় প্লট হস্তান্তরের পরিসংখ্যান প্রস্তুত হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি আবাসন প্রকল্প পূর্বাচল নতুন শহরের প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই প্রকল্পে প্রায় ২৬ হাজার প্লট রয়েছে যার সবগুলোই কয়েকবছর আগে বিক্রয় সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ শুরুর পর কয়েক বছরের তুলনায় এবছর প্লট বিক্রয় বেড়েছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালের তুলানায় এ বছর প্লট বিক্রয় বা হস্তান্তরের জন্য সবচেয়ে বেশী নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) দেওয়া নিয়েছে প্লট মালিকরা।
রাজধানী ও এর নিকটবর্তী এলাকায় বেশী প্লট বিক্রয়
অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বছর সারাদেশে ১ লাখ ৪৬ হাজার আবাসিক প্লটের মধ্যে শুধু ঢাকা জেলা ও মহানগরী; গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নারসিংদী ও মুন্সিগঞ্জ এলাকায় ক্রয়-বিক্রয়ের দলিল (সাফ-কবলা দলিল) নিবন্ধন হয়েছে ৮৯ হাজার ৪০০ টি। এই প্লটগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা।
অধিদপ্তর বলেছে, ঢাকা জেলা ও মহানগরীর আশুলিয়া, সাভার, কেরাণীগঞ্জ, দোহার, কালামপুর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ডেমরা, বাড্ডা, খিলগাাঁও, শ্যামপুর, ধানমন্ডি ও উত্তরা। এলাকায় বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের প্লট এগুলো।
নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি আবাসন প্রকল্পে (পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প) এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিক্রয় হয়েছে ৩,৬২৪ টি প্লট। যার মূল্য প্রায় ১ হাজার ৮৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রয় হয়েছে ২৩৩৮ টি প্লট, যার মূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কেরানীগঞ্জের সরকারি ঝিলমিল আবাসন প্রকল্পে এই বছর প্রায় ৬০০ প্লট বিক্রয় হয়েছে। উত্তরা-তৃতীয় পর্ব আবাসিক প্রকল্পে বিক্রয় হয়েছে ২০০০ এর মতো প্লট। গত বছরের তুলনায় বিভিন্ন প্লট মালিকরা এই বছর বেশী পরিমাণ প্লট বিক্রয় করেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে এই বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিক্রয় হয়েছে ২৬ হাজার প্লট।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট এ্যান্ড ডিজাইন) এ.এস.এম রায়হানুল ফেরদৌস টিবিএসকে বলেন, রাজধানী ও এর পাশ্ববর্তী এলাকায় এখনো ৫ টি সরকারি আবাসন প্রকল্পের উন্নয়ন চলমান। এছাড়াও প্রায় ২৫০ টি ছোট-বড় বেসরকারি বা প্রাইভেট আবাস প্রকল্প রয়েছে। সরকারি আবাসন প্রকল্পের প্লটগুলো সব বিক্রয় হয়েছে কিন্তু বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের বিভিন্ন প্লটের মালিকরা মালিকানা বদলের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো।
দেশের অন্যতম আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ ল্যান্ড ডেভালপমেন্টস লি. এর একজন বিপণন কর্মকর্তা বলেন, আমিন মোহাম্মদ হাউজিং এবং রিয়েল এসস্টেটের প্রায় ৩৫ টি প্রকল্প চলমান। কোভিড চলাকালীন সময়ে তাদের আবাসন প্রকল্পে প্লট বিক্রয়ের পরিমান একেবারেই কম। তবে বিভিন্ন সময় যে প্লটগুলো অনেকেই কিনেছেন, সেগুলোর একটা অংশ তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রয় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, প্লট বিক্রয় কম হলেও ফ্লাট বিক্রয় আগের তুলনায় বেড়েছে এই প্রতিষ্ঠানের।
রাজধানীর মালিবাগের 'তামান্না রেস্টুরেন্ট'র মালিক মোশাররফ হোসেন আফতাবনগরে তার তিন কাঠার একটি প্লট বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, দেড় বছরের মধ্যে প্রায় ১ বছর ব্যবসা পুরোই বন্ধ ছিল। কিন্তু রেস্টুরেন্টের ১৫ জন কর্মচারীর বেতন নিয়মিত দিতে হয়েছে।
'এদিকে পরিবারের ৫ সদস্যের সকলেই এ বছরের এপ্রিল মাসে করোনায় আক্রান্ত হই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বৃদ্ধ মা মারা গেলেন। আবার ৩ বছর আগে থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীর জটিলতা আরো বেড়ে গেলো কোভিড পরবর্তী জটিলতায়। দেশের চিকৎসকরা পরামর্শ দিলেন বিদেশে নিতে। সব মিলিয়েই পেরে উঠে পারছিলাম না। প্রায় ১৬ বছর আগে আফতাবনগরে কেনা ২ টি প্লটের একটি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছি ব্যবসা শুরু স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য।'
আরও ৫জন ভুক্তভোগীর সাথে আলাপ করে জানা যায় কোভিড জটিলতার প্রভাবে তারা বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে কেনা প্লট বেচতে বাধ্য হয়েছেন।
কিং এস্টেট এজেন্সি নামের একটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পে প্লট কেনা-বেচার মধ্যস্ততার কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আলী হাবীবব টিবিএসকে বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় করোনাকালীন ২০২০ ও ২০২১ সালে প্লট বিক্রয়ের মধ্যস্ততা বেশ হয়েছে। গত বছর প্রায় ১১০০ প্লট সেল হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যস্ততায়। এই বছরও প্রায় ৮০০ বিক্রয় হয়েছে তাদের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলডিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও মাগুরা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহিউদ্দিন বলেন, বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের প্লট সরাসরি বিক্রয় কমলেও, যারা আগে কিনেছেন, করোনার মধ্যে তাদের অনেকেই সেল করে দিচ্ছেন তাদের প্লট।
তিনি বলেন, ল্যান্ড ডেভেলপারদের ব্যবসা করোনার মধ্যে বেশ ঝুঁকিতে পড়েছিল। এখন আবার একটু ভালোর দিকে যাচ্ছে।