মৎস্য রপ্তানি খাতে ধস, কারখানা বন্ধ হয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে
স্বাধীনতার আগে থেকেই মৎস্য রপ্তানি খাতে ব্যবসা করে আসছে মিনহার সি ফুডস লিমিটেড। চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা শুরু করে পরবর্তী সময়ে কক্সবাজারেও একটি কারখানা গড়ে তোলে প্রতিষ্ঠানটি। মিনহার সি ফুডসকে এই খাতের অগ্রদূত মনে করেন পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় আসা উদ্যোক্তারা। কিন্তু মৎস্য রপ্তানি খাতের ক্রমাগত দুরবস্থার কারণে দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখা সেই প্রতিষ্ঠানটি এখন বন্ধের পথে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রায় শত কোটি টাকা।
মিনহার সি ফুডস দীর্ঘদিন এবি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে। ব্যবসা মন্দা হওয়ায় এবি ব্যাংক ঋণ সুবিধা কমিয়ে দিলে ২০১৭ সালে সব দেনা পরিশোধ করে ওয়ান ব্যাংকে চলে যায় মিনহার। এরপর বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। যা বর্তমানে প্রায় শত কোটি টাকা।
ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপক জানান, মিনহার সি ফুডস মৎস্য রপ্তানি খাতের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সালে এই শাখায় ব্যবসা শুরুর পর ২০১৮ পর্যন্ত ভালোই চলছিল প্রতিষ্ঠানটির লেনদেন। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি কমে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির দুই কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মিনহার সি ফুডসের কাছে পাওনা শত কোটি আদায়ে ঝুঁকি বাড়ছে।
শুধু মিনহার নয়, হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি খাতের আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেসার্স কোস্টাল সি ফুডস এর কাছে সোনালী ব্যাংকের ৭৩ কোটি টাকা, কুলিয়ারচর সি ফুডস (কক্সবাজার) এর কাছে একই ব্যাংকের ৬৫ কোটি টাকা, মেসার্স মেঘনা সি ফুডস এর কাছে কৃষি ব্যাংকের ৫৯ কোটি টাকা, সার এন্ড কোং এর কাছে সোনালী ব্যাংকের ৪৭ কোটি টাকা ছাড়াও সি ফুডস করপোরেশন (চাঁন্দপুর) এর কাছে সোনালী ব্যাংকের বড় অংকের পাওনা আটকে গেছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এক সময় দেশে প্রায় ১৪০টি হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি কারখানা ছিল। এরমধ্যে ৫০টির বেশি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ১০৬টি কারখানা সমিতির তালিকাভুক্ত থাকলেও মূলত মৎস্য রপ্তানি করছে ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামের সাগরিকা বিসিক শিল্প জোন ও কালুরঘাট বিসিক শিল্প জোনে বছর পাঁচেক আগে হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি করে এমন প্রায় ৭৫টি প্রতিষ্ঠান ছিল। বন্ধ হতে হতে করোনার আগে ৪৪টি প্রতিষ্ঠানে এসে ঠেকে। এসব কারখানার মধ্যে মাত্র ৫-৬টি কোনভাবে টিকে আছে। তাদের অবস্থাও খুব নাজুক।
এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ খাত থেকে রপ্তানি আয় কমছে। ২০০৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকার মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মৎস্য ও মৎসজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। সেই হিসেবে, গত বছরের তুলনায় প্রায় ৫২৭ কোটি টাকা রপ্তানি কমেছে এ বছর। বর্তমান অবস্থা আরও খারাপ।
এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে ৪ হাজার ২২৮ কোটি টাকা আয় করেছে। আগের অর্থবছরে (২০১৭-১৮) আয় ছিল ৪ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরে আয় কমেছে ৮১ কোটি টাকা।
ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা রপ্তানি আয় হয়।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের সহসভাপতি আশরাফ হোসাইন মাসুদ বলেন, করোনায় মৎস্য রপ্তানি খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ৭৫ শতাংশ বাজার হারিয়েছে মৎস্য রপ্তানি খাত। করোনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউনে হোটেল, রেস্তোরাঁ বন্ধ। পর্যটন খাতও স্থবির। তাই রপ্তানি কমেছে। তাছাড়া আমাদের প্রধান ক্রেতা সৌদি আরব আমাদের থেকে আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। সাগরে মাছের পরিমাণও কমেছে, বাগদা চিংড়ির উৎপাদনও কমে গেছে।
এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে শিগগিরই সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাজার খুলে দেওয়া জরুরি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে এ খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করতে হবে সরকারকে।
এদিকে মৎস্য খাতের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে মেসার্স ইফফাত ইন্টারন্যাশনালের কাছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা, রেইনবো সি ফুডস'র কাছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ১২ কোটি টাকা, মেসার্স মোস্তফা শ্রিম্প প্রোডাক্টস'র কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২ কোটি টাকা, মেসার্স ফিস মার্ক এক্সপোর্টের কাছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক নাসিরাবাদ শাখার ২ কোটি টাকা, জিলানী সি ফুডস'র কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সদর ঘাট শাখার ৪ কোটি টাকা ও মেসার্স চিটাাগাং সি ফুডসের কাছে কৃষি ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ঋণ খেলাপি হয়ে আছে।
সোনালী ব্যাংকের তথ্যমতে, মৎস্য রপ্তানি খাতে ব্যবসা করতে দীর্ঘদিন ধরে সোনালী ব্যাংক লালদিঘী শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে আসছে মেসার্স কোস্টাল সি ফুডস লিমিটেড। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের ঋণমান ভালো ছিল। কিন্তু ২০১৫ থেকে মৎস্য রপ্তানি খাতে মন্দা শুরু হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক ঋণ পরিশোধেও ভাটা পড়ে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে আটকে পড়ে ব্যাংকটির প্রায় ৭৩ কোটি টাকা। বহু চেষ্টা তদবির ব্যর্থ হয়ে পাওনা আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চেক ও অর্থঋণ মামলা দায়ের করেছে পাওনাদার ব্যাংক।
এই ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকা বিসিক শিল্প জোনের ৪৮ শতক জমিসহ কারখানাটি বন্ধক রয়েছে। কিন্তু কারখানাসহ বন্ধক রাখা এই জমির বর্তমান মূল্য ব্যাংকের পাওনার তুলনায় খুবই সামান্য।
সোনালী ব্যাংক চট্টগ্রামের জেনারেল ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "মামলার পাশাপাশি সমঝোতার মাধ্যমেও ঋণের টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান মালিকের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বিশেষ সুবিধা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে রি-শিডিউলের মাধ্যমে ঋণটি নিয়মিত করার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না"।
মৎস্য রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তা রিভারাইন ফিশ এন্ড ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান চৌধুরী বলেন, "হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। যেই পরিমাণ প্রতিষ্ঠান এই খাতে ব্যবসায় এসেছে সেই পরিমাণে মৎস্য উৎপাদন বাড়ে নি। বরং বছর বছর উৎপাদন কমেছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, রাশিয়া ইত্যাদি দেশ বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের প্রধান আমদানিকারক দেশ। গত কয়েক বছরে ভিয়েতনামের ভেন্নামি চিংড়ি সেই বাজার দখল করে নিয়েছে"।
মৎস্য রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আশির দশক থেকে মৎস্য খাতে বড় বড় উদ্যোক্তা তৈরি হয়। এরপর ২০০৪-২০০৫ পর্যন্ত এই খাতে ভালো ব্যবসা হয়। কিন্তু এরপরও বছর বছর নতুন উদ্যোক্তা যোগ হয় এই খাতে। এরমধ্যে অনেকে ব্যবসা না বুঝে শখের বশে মৎস্য রপ্তানি ব্যবসায় চলে আসে। আবার অনেকেই মৎস্য রপ্তানির নামে কারখানা বা প্রজেক্ট তৈরি করে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা দিয়ে ভোগবিলাস করেছে। ব্যাংক ঋণের টাকায় ব্যবসার পরিবর্তে জমি কিনেছে, ফ্ল্যাট কিনেছে।
বছর বছর যেই পরিমাণ প্রতিষ্ঠান বেড়েছে সেই পরিমাণ মৎস্য সম্পদের উৎপাদন না বাড়ায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে কাঁচামাল (মৎস্য) ক্রয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা হয়েছে। কিন্তু রপ্তানিকৃত পণ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সেই দাম মেলে নি। যার ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের বড় লোকসান গুনতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আমিনুল্লাহ বলেন, "গত কয়েক বছর ধরে হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি খাতের দুরবস্থা চলছে। রপ্তানি কমে গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। অথচ এক সময় দেশের রপ্তানি আয়ের শীর্ষে ছিল এই মৎস্য রপ্তানি খাত"।