যুক্তরাষ্ট্রের দুই লাখ কোটি ডলারে কেনা পরাজয়ের কড়চা
আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধের মূল্য গণনার জন্য আজ আর মানদণ্ডের অভাব নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড সম্ভবত মার্কিনীদের রক্তক্ষয়ের পরিসংখ্যান। সে তুলনায় সম্পদের বিনিয়োগ অনেক নগণ্যই দেখায়। কিন্তু, তালেবান শাসন থেকে কাবুল বিমানবন্দরমুখী জনস্রোত দিচ্ছে ভিন্ন চিত্র। এ বাস্তবতায় আফগানিস্তানকে একটি উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্র যে ব্যয় করেছে তার একটি সঠিক সমীক্ষা অপরিহার্য। অন্যথায়, এখান থেকে পাওয়া শিক্ষা ভুলে যাবে আগামীদিনের মার্কিন প্রশাসনগুলো; করবে একই মর্মান্তিক ভুলের পুনরাবৃত্তি।
কোন জাতি গঠনের আবশ্যক উপাদান নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। জনগণ নিজ দেশে নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি ও ঘুষ সমাজে আসন গেড়ে বসে। ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায় প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির ভিত্তি।
২০০১ সালে, আফগানিস্তানের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল দুই দশকেরও বেশি যুদ্ধের কারণে যা ওই বছরের অক্টোবরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের আগেই হয়েছিল।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের কস্টস অব ওয়ার প্রজেক্টের গবেষকদের হিসাব অনুসারে, ২০০১ সালের পর থেকে আফগানিস্তানে মোট দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সবচেয়ে বড় অংশ যায় প্রতিরক্ষা দপ্তর- পেণ্টাগনের ওভারসীজ কন্টিজেন্সি অপারেশন্স বাজেটে। দ্বিতীয় বৃহৎ খরচ খাত ছিল যুদ্ধের খরচ মেটাতে মার্কিন সরকারের গৃহীত ৫৩ হাজার কোটি ডলারের ঋণ।
কিন্তু, এত লাখ লাখ কোটি ডলার ব্যয়ের পরও আজও বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি আফগানিস্তানের। গেল বছর, খোদ আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি স্বীকার করেন, দেশটির ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠী দৈনিক দুই ডলারের কম আয়ের ওপর নির্ভর করে জীবনধারণ করছে।
অন্যদিকে, ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে অবৈধ অর্থনীতি। ২০০১ সালে মার্কিন বাহিনী তালেবান সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করার পর বিশ্বের প্রধানতম আফিম ও হেরোইন সরবরাহকের স্থান অধিকার করে আফগানিস্তান। তালেবানের শাসন ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে আসার বাস্তবতায় কুখ্যাতির এ শিরোপা খুব সম্ভবত আগামীদিনেও ধরে রাখবে দেশটি।
এত বিনিয়োগের এ ফলাফলই যখন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লানির পক্ষে যথেষ্ট, সেখানে যাদের কাঁধে দেশরক্ষার ভার ছিল সেই আফগান সেনাবাহিনী ও সরকারের পতন লজ্জায় ফেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থানকে।
প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি দেশ ছেড়ে পালান আর তার ডেস্কের পেছনে চেয়ারে বসে সেলফি তুলেছে তালেবান যোদ্ধারা। এই ছিল আসলে দুই লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগের ফসল; এক বিশৃঙ্খল, অপমানজনক অন্ত ২০ বছরব্যাপী যুদ্ধের।
হিসাবের নির্মম খেরোখাতা:
২০০১ সালের পর আফগানিস্তান পুনর্গঠনে সাড়ে ১৪ হাজার ডলারের বেশি ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বেশিরভাগ তহবিল পায় আফগান নিরাপত্তা বাহিনী, জনপ্রশাসন উন্নতি, অর্থনৈতিক সহায়তা ও সামাজিক উন্নয়ন জোরদার করার কাজে মার্কিন সরকার নির্দিষ্ট এনজিও এবং বেসরকারি ঠিকাদাররা। তালেবানের আয় উৎস মাদক বাণিজ্য বন্ধেও খরচ হয়েছে বিপুল অর্থ।
এসকল পুনর্গঠন প্রচেষ্টার সবচেয়ে গুরুতর ও ব্যয়বহুল ব্যর্থতা ছিল- আফগান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের পেছনে করা ৮ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার ব্যয়। ২০০২ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত করা ব্যয় এ হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছে।
আফগান সেনাবাহিনীর ওপর অর্পিত প্রধান দায়িত্ব ছিল যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারের অস্তিত্বের জন্য হুমকি তালেবানসহ আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গিদের প্রতিহত করা। কিন্তু, বিদ্যুৎগতির তালেবান অগ্রযাত্রার মুখে ৩ লাখ সদস্যের আফগান বাহিনী সমান গতিতে আত্মসমর্পণ করেছে তা যেন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আফগান সামরিক বাহিনীর ওপর সেনাদের উবে যাওয়া বিশ্বাসেরই প্রতিবিম্ব। যে সরকার ও রাষ্ট্রকে তারা রক্ষার শপথ নিয়েছিল তার উপর মারাত্মক অনাস্থার প্রতিফলন।
আফগানিস্তানের অনন্য ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়াদি নিঃসন্দেহে এ ফলাফলকে রূপ দিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু, মার্কিন খরচের শিথিল পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নও সমানভাবে দায়ী।
খরচাপাতির সঠিক মুল্যায়নের লক্ষ্যেই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস), আফগানিস্তান পুনর্গঠন বিষয়ক মহাপরিদর্শকের দপ্তর (সিগার) সৃষ্টি করে। ২০০৮ সাল থেকে সিগার আফগানিস্তান পুনর্নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়কে পর্যালোচনা শুরু করে। কিন্তু, অর্থের অপচয়, জালিয়াতিসহ ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরতে ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সুপারিশে সিগারের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলির প্রেক্ষিতে মার্কিন সরকার ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
যেমন; ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা 'আফগান বিদ্রোহীদের টিকে থাকার সক্ষমতাকে খাটো করে দেখে নেওয়া হয়েছে' বলে উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সামর্থ্যকে বাড়িয়ে ভেবেছে ওয়াশিংটন।
অত্যাধুনিক পশ্চিমা সমরাস্ত্র দিয়ে প্রায় নিরক্ষর আফগান বাহিনীকে সজ্জিত করার চেষ্টা করেও যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ভুল করছে বলে সিগারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এর মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের বদলে উল্টো মার্কিন বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে।
প্রতিবেদনটি আরো জানায়, আফগান বাহিনীর প্রশিক্ষণ মনিটরে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলোয় দুর্নীতি ও সেনাদের লড়াই করার অনিচ্ছাকে ইচ্ছে করেই উহ্য রাখা হচ্ছে।
গত মাসে সিগার ১০ম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম ছিল-'লেসন লার্নড' বা গৃহীত শিক্ষা।
মহাপরিদর্শক জেনারেল জন এফ সোপকো সেখানে বিশেষ সারাংশে লিখেছেন, "আফগানিস্তানের মতো অনির্দেশ্য ও বিশৃঙ্খল বাতাবরণে দুর্বল নজরদারি ও ভুল বাস্তবায়ন স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে। এতে বিপন্ন হবে মার্কিন ও আফগান সরকারের কর্মকর্তা ও সাধারণ নাগরিকের জীবন। এটি আমাদের কৌশলগত লক্ষ্যেরও পরিপন্থী।"
৩২৪ পৃষ্ঠার এবারের প্রতিবেদনটি তথ্যবহুল ও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সব বিশ্লেষণ জায়গা করে নিয়েছে। শুরু থেকে পড়লে মনে হবে, প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় 'স্লো-মোশনে' আফগানিস্তানে মার্কিন সম্পৃক্ততার বিশাল ট্রেনের দুর্ঘটনা দেখছেন। জেনারেল সোপকো কোন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকলে তার দপ্তর আরো ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারতো সেদিকেও আলোকপাত করেছেন।
"স্বতঃসিদ্ধ সত্যের মতো যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে বড় পরিসরের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জরিয়ে পড়ে। আজ থেকে কয়েক বছর বা কয়েক যুগ পর যুক্তরাষ্ট্র যদি আবারো এমন প্রচেষ্টায় জড়ায়- আফগান যুদ্ধের এবারের ফলাফল, শিক্ষা ও সুপারিশগুলোকে সেসময় গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে।"
গুরুত্বপূর্ণ পাঠ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হলেও, আফগানিস্তান রক্ষায় শিক্ষাগ্রহণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
- সূত্র: আল জাজিরা