যেভাবে ১৫০ কোটি টাকার জুতা শিল্প গড়ে উঠল রাজশাহীর গ্রামে
দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাবাকে হারান মনজুর রহমান (৪৫)। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে বেশ কয়েকদিন না খেয়েও থাকতে হয় মনজুরের পরিবারকে। বিধবা মা ও ছয় বোনের ভরণপোষণ দায়িত্বের চাপে আর পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি তার। তারপর হতাশা ও পরিবারের দারিদ্রতা ঘুচানোর জন্য কখনো মৌসুমি কৃষি শ্রমিক, আবার কখনো রাস্তায় সবজি বিক্রি করেন তিনি, সর্বশেষ এক বন্ধুর পরামর্শে জুতা তৈরির চিন্তা করেন মনজুর।
নিজের জমানো ২০ হাজার টাকা এবং মানুষ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ২০১৪ সালে নিজ বাড়িতে গড়ে তোলেন ছোট্ট পাদুকা ইন্ডাস্ট্রি। ছয় বছরের ব্যবধানে মেশিনারিজ ও অন্যান্য সম্পদ মিলে বর্তমানে প্রায় ১.৫ কোটি টাকার মালিক মনজুর রহমান। নিজের দারিদ্রতা ঘুচিয়ে ইতোমধ্যে পাঁচ বিঘা জমিও কিনেছেন তিনি।
কালুহাটি পাদুকা সমিতির সভাপতি মনজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "মাত্র ৩ জন কর্মচারী নিয়ে 'মনজিল সু' নামে আমি আমার ফ্যাক্টরি শুরু করি। এখন আমার কারখানায় ৭০ জনের অধিক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, এখন আমার বছরে বিক্রি হয় প্রায় ৭০-৮০ লাখ টাকার জুতা।"
গত চার দশকে রাজশাহীর চারঘাট নিমপাড়া ইউনিয়নের কালুহাটি গ্রামের একেকটি ঘর এখন একেকটি জুতা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। দারিদ্র্য ঘোচানো গ্রামটিতে বর্তমানে কোনো বেকার নেই বললেই চলে। অভাবী গ্রামের চেহারা পাল্টে কালুহাটি এখন দেশের সাফল্যমণ্ডিত একটি গ্রাম।
এক গ্রামেই ৬৮টি জুতা তৈরির কারখানা। তাই গ্রামটিকে পাদুকা পল্লী হিসেবেই সবাই চেনে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কাজে জড়িত। নারী-পুরুষ, শিশু সবাই এই কাজ করেন। কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়োজিত জুতা তৈরির কাজে। প্রতিবছর ঈদের আগে তাদের এত বেশি কাজ থাকে যে, দম ফেলার ফুরসতও থাকে না।
২০১৪ সালে মনজিল সুজ কারখানায় সামান্য বেতনে শ্রমিকের কাজ শুরু করেন লালন হোসেন (৩৫)। বর্তমানে তিনি মাসে ৩০ হাজার টাকার অধিক আয় করেন একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। তিনি টিবিএসকে বলেন, "গত ছয় বছরে আমি জুতা তৈরির একজন দক্ষ কারিগরে পরিণত হয়েছি, বর্তমানে আমার পরিবারে তেমন অর্থকষ্ট নেই, আশা করি আগামী ৫ বছরে কাজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আমার বেতন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা হয়ে যাবে।"
কালুহাটি পাদুকাগুলোর ৯০ শতাংশই চামড়ার তৈরি, বাকি ১০ শতাংশ পাট ও রেকসিনের কাঁচামালের তৈরি। এসব কাঁচামাল পুরান ঢাকার বংশাল, সিদ্দিক বাজার ও চট্টগ্রাম থেকে কিনে নিতে হয়। তবে উন্নত অত্যাধুনিক মেশিনারিজ না থাকায় সব ধরণের জুতা হাতেই তৈরি করতে হয় এখনো।
কালুহাটি পাদুকা সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে কালুহাটিতে পায় ৬৮টি কারখানা রয়েছে এবং ১১৭ ব্যবসায়ী এসোসিয়েশনের সদস্য। বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার টার্নওভার হয়। প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ জুতা তৈরি করা হয়।
এ খাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান জড়িত, যার ৩০ শতাংশই নারী।
কারখানা মালিকদের ৮০-৯০ শতাংশই এক সময় এ খাতের শ্রমিক বা কারিগর ছিলেন। পরবর্তী পাঁচ-দশ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেই প্রতিষ্ঠান খুলে মালিক বনে যান।
তেমনি একজন সফল ব্যবসায়ী 'বিজয় সুজ' এর মালিক মোঃ রানা আহমেদ। তিনি ছয় বছর বয়সে বাবাকে হারান; মা মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করে তাকে ৮ম শ্রেণি পযন্ত পড়াতে সমর্থ হন।
রানা আহমেদ ১৯৯৫ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সেই জুতার কারখানায় শ্রমিকের কাজে লেগে পড়েন, আস্তে আস্তে শ্রমিক থেকে কারিগর হন। তারপর ২০০৭ সালে তিনি মাত্র ৪৫ হাজার টাকা পুঁজি ও ৪ জন কর্মচারি নিয়ে ভাড়া দোকানে ছোট্ট একটি পাদুকা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলেন।
রানা আহমেদ বলেন, "এখন আমার কারখানায় সবমিলিয়ে ৭৫ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে, এখন আমি বছরে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার পিস জুতা উৎপাদন করি, বছরে ৪০ লাখের অধিক টাকার জুতা বিক্রি হয়ে থাকে, কিছুদিন আগে আমি ১৭ লাখ টাকার জমি কিনেছি। সামনে কারখানার জন্য পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজ শুরু করবো।"
জানা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় এক দশক পরও এ কালুহাটি গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার ছিল নিম্ন আয়ের। ওই সময় গ্রামের অভাবী পরিবারের দুই যুবক আমিরুল ইসলাম আর বারিক ঢাকায় সিদ্দিকবাজারে কাজ নেন একটি জুতা-স্যান্ডেল কারখানায়। টানা ৯ বছর সেখানেই কাজ করেন।
১৯৮০ সালে কালুহাটি পাদুকা পল্লী গড়ে তোলার প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন সুবেদার আমজাদ হোসেন। এরপর জুতা তৈরির আরও প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আমিরুল, বারেক, আমজাদ হোসেন, কাশেম ও দেলশাদ ভৈরব যান। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষ করে কালুহাটে ফিরে দেলশাদ ও আমজাদ হোসেন দু`জনের মালিকানায় 'মুক্তা সু' নামে একটি কারখানা চালু করেন। বর্তমানে গ্রামটির নিউ মান্নান, ন্যাশনাল, ডায়মন্ড, শ্রাবণী, পায়ে পায়ে, শিশির, মেঘলা, রানা, সিয়াম, রাসেল, মডার্ন, দেশ, এমএফ, নাজ ওয়ান, রবিনসহ নানা নামের জুতা কারখানা দেশব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছে।
করোনার আঘাত
কালুহাটি পাদুকা শিল্পও করোনায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
পাদুকা সমিতির তথ্যমতে, করোনার প্রভাবে গত দেড় বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে এ খাতে। ইতোমধ্যে ৭টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার প্রভাবে মাত্র ১৪ লাখ জুতা কম উৎপাদিত হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৮ লাখ কম উৎপাদন হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ২৫ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। এখনো প্রায় ২৫% পণ্য অবিক্রিত রয়ে গেছে ,স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ পণ্য বিক্রি ও অর্ডার কম হচ্ছে। কোন উদ্যোক্তাই সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ পায়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একজন 'নিউ সরকার সুজ' কারখানার মালিক রবিউল ইসলাম। তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমি স্বাভাবিক সময়ে বছরে প্রায় ২৫ লাখ টাকার জুতা বিক্রি করতাম, লকডাউনের সময় আমার আয় একদম বন্ধ হয়ে যায়, মানুষের কাছে প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা বকেয়া আটকা পড়ে। একদিকে জুতার অর্ডার কমে যাওয়া,অন্যদিকে বকেয়া টাকা তুলতে না পারা ও ১০ জন শ্রমিকের বেতন দিয়ে পোষাতে না পেরে সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে পুরোপুরি এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হই।"
"করোনাকালীন সরকারের কোন প্রণোদনা পাইনি এবং স্থানীয় ব্যাংকে ঘুরেও কোন ঋণ সহযোগিতা পাইনি, এখন আমি আবার চাচ্ছি কারখানা চালু করতে, তবে এখনও কোন অর্থ সংস্থান হয়নি", যোগ করেন রবিউল।
রয়েছে দারুণ সম্ভাবনা
ভৈরবসহ দেশের অন্যান্য স্থানে জুতা শিল্প ইদানিং যন্ত্রনির্ভর কারখানা স্থাপনের দিকে ঝুঁকলেও কালুহাটিতে সবগুলো কারখানা এখনো হাতেই জুতা তৈরি করে। একেকটি যন্ত্রের কারখানা দিতে যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন, সে পুঁজির অভাবে পুরোনো অনেক উদ্যোক্তাই কারখানা স্থাপনে পিছিয়ে যাচ্ছেন।
কালুহাটি পাদুকা সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা টিবিএসকে বলেন, "কালুহাটি পাদুকাশিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তবে এখানে প্রচুর পুঁজির প্রয়োজন। সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা নেই। ব্যাংকের ঋণ মেলে না। সেজন্য অনেক চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।"
তিনি আরও বলেন, "এসএমই ফাউন্ডেশন কালুহাটির পাদুকা শিল্পের জন্য ২.৫ কোটি টাকার অত্যাধুনিক মেশিনারিজ হস্তান্তরের আশ্বাস দিয়েছে। আশা করি, তা পেলে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এছাড়া সরকার যদি এখনকার উদ্যোক্তাদের স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ সুবিধা দেয়, তাহলে এ খাতে আগামী দিনে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং আমাদের পণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববাজারেও স্থান করে নিবে।'