সরকারকে সেবা দিতে গিয়ে মূলধন আর মুনাফা হারাচ্ছে সোনালী ব্যাংক
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাস্তবায়নের বিপরীতে কোন বাণিজ্যিক মূল্য না পাওয়ায় মুনাফা কমার পাশাপাশি মূলধন ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে জানিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংক বলেছে, মূলধন ঘাটতির কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যাংকটির ভাবমূর্তিও ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে মূলধন ঘাটতি কমানোর পাশাপাশি মুনাফা বাড়াতে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিপরীতে অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে বাণিজ্যিক মূল্য চেয়েছে ব্যাংকটি।
গত ১১ এপ্রিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের কাছে পাঠানো চিঠিতে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান প্রধান লিখেছেন, সরকারকে বিনামূল্যে সোনালী ব্যাংক যে সেবা দিচ্ছে, তার আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় ২৬১৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক যুগে সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা বিভিন্ন সেবার ফি বা মূল্য হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ১৭,১২২ কোটি টাকা চেয়েছে ব্যাংকটি।
সোনালী ব্যাংক বলছে, সরকারের নির্দেশনায় সিভিল পেনশন ও পাবলিক পেনশনের উপকারভোগীদের পাওনা সোনালী ব্যাংক নিজস্ব তহবিল থেকে পরিশোধ করে। এতে বছরে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা খরচ হয়। পরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কাছে পুনঃভরণ দাবি পেশ করার পর যথাযথ নিরীক্ষা ও বাজেট বরাদ্দের পর ওই পরিমাণ টাকা সোনালী ব্যাংকের পেতে প্রায় বছরব্যাপী অপেক্ষা করতে হয়। ব্যাংকের গড় কস্ট অব ফান্ড ৭% হারে এই অনাদায়ী হতে প্রতি বছর ব্যাংকের ক্ষতি হচ্ছে ১৭৭.৪৩ কোটি টাকা, ১২ বছরে এর পরিমাণ প্রায় ২১২৯.১৯ কোটি টাকা।
পেনশনখাতে ব্যয় করা অর্থ সরকারের কাছ থেকে পাওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাংকের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিমাসে এ খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার অর্ধেক অগ্রিম হিসেবে সোনালী ব্যাংককে পরিশোধ করা যেতে পারে, অথবা ব্যাংকের তহবিল পুনঃভরণ না করা পর্যন্ত কস্ট অব ফান্ড হারে সুদ দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে বলেছেন আতাউর রহমান।
সোনালীর ৩৮টি শাখা শুধু জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের পক্ষে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও নগদায়ন করে থাকে জানিয়ে ব্যাংকটি বলেছে, ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করে অধিদপ্তরের পক্ষে সঞ্চয়পত্রের সুদ ও পুনঃভরণ দিয়ে থাকে। পরে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওই পরিমাণ অর্থ পায় সোনালী ব্যাংক। এ কাজে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা সারা বছর নিয়োজিত থাকে। এই অর্থ থেকে ব্যাংক একদিকে যেমন কোন আয় পায় না, তেমনি ওই টাকা অন্যখাতে বিনিয়োগ হতেও বঞ্চিত হচ্ছে।
ব্যাংকটির হিসাব মতে, আমানতকারীদের আমানতের অর্থ হতে ওই টাকা পরিশোধ করা হয় বিধায় এর জন্য গড় কস্ট অব ফান্ড হারে বছরে প্রায় ১২৬ কোটি টাকার দায় বহন করতে হয়। এর ফলে ব্যাংক বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ওই ৩৮টি শাখায় নিয়োজিত ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বছরে বেতন-ভাতা বাবদ ৪২ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এছাড়া, শাখাগুলোর স্থাপনা ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ যেমন সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও নগদায়ন বাবদ সোনালী ব্যাংকের বছরে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৬৮.৪২ কোটি টাকা, এক যুগে যার পরিমাণ প্রায় ২০২১ কোটি টাকা।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের পক্ষে এসব কাজের বিপরীতে শতকরা ৫ টাকা কমিশন দেওয়া এবং ব্যাংকের তহবিল ব্যবহারের পর ক্ষতিপূরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র পুনঃভরণ বিল দাখিলের তারিখ হতে পুনঃভরণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের জন্য ব্যাংক রেটে সুদ দাবি করেছেন সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতাসহ সরকারের ৫১টি কর্মসূচির মধ্যে ১৪টি কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিপরীতে ফি পেলেও ৩৭টি সেবা বিনামূল্যে বাস্তবায়ন করছে সোনালী ব্যাংক। এসব সেবা বাস্তবায়ন করতে শাখাগুলোতে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভাড়া, স্টেশনারী, নেটওয়ার্কিং ও কম্পিউটার সরঞ্জামাদি বাবদ বছরে সোনালী ব্যাংকের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩৫৭.৬০ কোটি টাকা।
'এসব সেবা বাবদ কোন ধরণের সার্ভিস চার্জ বা কমিশন না পাওয়ায় ব্যাংক নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে বার্ষিক মুনাফা অর্জনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। ব্যাংকের মুনাফার ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমানোসহ মূলধন ঘাটতি দূরকরণে এসব সেবার বিপরীতে সেবামূল্য হিসেবে কমপক্ষে ১% সার্ভিস চার্জ আরোপ করা প্রয়োজন', যোগ করেছেন আতাউর রহমান।
দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এলসি স্থাপন করতে গিয়ে বছরে প্রায় ১৫০৮ কোটি টাকা ক্ষতি হওয়ার তথ্য তুলে ধরে সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৭ সালে সরকার সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে ৯৪,২৪৬ কোটি টাকা মূল্যের একটি বিশেষ এলসি স্থাপন করে।
সাধারণত সরকারের যেকোন এলসি ইস্যুর বিপরীতে নির্ধারিত কমিশনের হার ০.৪%, যা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আরোপযোগ্য। এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে এলসির সম্পূর্ণ নিষ্পত্তির মেয়াদ ৭ বছর ধরা হলে এলসির বিপরীতে গড়ে ৩.৫ বছর কমিশন আরোপযোগ্য হবে। সে বিবেচনায় কমিশন বাবদ বছরে ১৫০৮ কোটি টাকা ও পূর্ণ মেয়াদে ৫২৭৮ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হতো। কিন্তু সরকার পুরো মেয়াদে মাত্র ২০ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছে। এতে প্রায় ৫২৫৮ কোটি টাকার আয় হতে বঞ্চিত হওয়ার তথ্য তুলে ধরে অন্তত ০.২০% হারে কমিশন চেয়েছে সোনালী ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের ক্ষতির হিসাব এখানেই শেষ নয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বাংলাদেশ জুটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) ও স্পেশাল ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেও প্রতিবছর ক্ষতি গুণতে হচ্ছে।
বিপিসিকে প্রচলিত হারে ঋণ দেওয়ার পর তা সমন্বয় করতে ২০০৭ সালে সরকারের নিকট হতে ৫% সুদে পাওয়া বন্ডের বিপরীতে বর্তমান স্থিতি ১৪৬৫ কোটি টাকা এবং ২০১১-২০১৩ সালে ৭% সুদে ইস্যুকৃত বন্ডের বিপরীতে স্থিতি ১৬৭১ কোটি টাকা। ৬ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ডের বিপরীতে ব্যাংক ঋণের গড় সুদ হার ৯% বিবেচনায় নেওয়া হলে বছরে সোনালী ব্যাংকের ক্ষতি দাঁড়ায় ৯২ কোটি টাকা এবং বন্ডের মেয়াদকাল পর্যন্ত পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ হবে ১১৫৫ কোটি টাকা।
একইভাবে বিজেএমসির কাছ থেকে ২০১১ সালে ৫% সুদে ৩৯৩ কোটি টাকার বন্ড পায় সোনালী ব্যাংক, যার মেয়াদ ২০২৩ পর্যন্ত। এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার বিবেচনায় নিলে সোনালী ব্যাংকের মোট ক্ষতি হবে ১৯০ কোটি টাকা।
এছাড়া ওরিয়ন গ্রুপ এবং আইসিডি-কে দেওয়া ঋণ ও সুদ মওকুফের বিপরীতে পাওয়া ৪৭৬ কোটি টাকার স্পেশাল ট্রেজারি বন্ডের ক্ষেত্রে ব্যাংকঋণের গড় সুদহার বিবেচনায় নিলে সোনালী ব্যাংকের পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭৬ কোটি টাকা।
এসব বন্ডের সুদহার বাড়িয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ৯% হারে উন্নীত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অনুরোধ করেছে সোনালী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এজেন্ট হিসেবে সোনালী ব্যাংক ৬৬টি চেস্ট ও সাব-চেস্ট শাখাসহ মোট ৭৩২টি ট্রেজারি শাখার মাধ্যমে সরকারি লেনদেন সম্পাদন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন শাখা নেই, এমন সব জেলা-উপজেলায় সোনালী ব্যাংক চেস্ট ও সাব-চেস্ট শাখা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে কাজ পরিচালনা করে। চেস্টের নিরাপত্তা দেওয়া ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে কাজ করতে নিয়োজিত জনবল নিয়োগ দেওয়া, পুলিশ স্কোয়াড মোতায়েন এবং স্পেশাল ভল্ট ও চেস্ট রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় সোনালীকে। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয়ের একটি অংশও এ খাতে ব্যয় হয়।
৫৮টি চেস্ট ও ৮টি সাব-চেস্ট শাখার জন্য পুলিশ স্কোয়াডের পেছনে সোনালী ব্যাংকের বাৎসরিক ব্যয় প্রায় ৫৯ কোটি টাকা, ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ৭৭ কোটি টাকা, স্পেশাল ভল্ট রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় ২৯ কোটি টাকা। অন্যান্য শাখার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ করতে গিয়ে বছরে সোনালীর ব্যয় হচ্ছে আরও ৩৮৯ কোটি টাকা। এসব ব্যয়ের কমপক্ষে অর্ধেক পুনঃভরণযোগ্য বিবেচনার প্রস্তাব করে সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেছেন, এতেও বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬৭ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে ট্রেজারি কার্যক্রম পরিচালনার বিনিমিয়ে এজেন্সি চুক্তি মোতাবেক মোট লেনদেনের ওপর ০.২০% হারে কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৯৯ সালে। গত ২২ বছরে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি সেবা সহজলভ্য করতে এখাতে ব্যয় বেড়েছে। তাই বিদ্যমান কমিশন হার দ্বিগুণ করার অনুরোধ করেছে ব্যাংকটি।