হঠাৎ পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে বেকায়দায় খামারিরা
হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে পশুখাদ্যের দাম। গত দুই সপ্তাহে বাজারে পশুখাদ্যের প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি ও লকডাউনে দুধের দাম কমলেও পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ডেইরি খাতের উদ্যোক্তারা। কারখানা ও গুদামে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও খাদ্য উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকরা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে পশুখাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ খামারিদের।
তবে দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে পশুখাদ্যের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও লকডাউনের কারণে আর্ন্তজাতিক বাজার থেকে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় পশুখাদ্যের দামও কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বাজারে প্রতিবস্তা (৩৫ কেজি) ভালো মানের গমের মোটা ভুষি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫০ টাকা দরে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে একই মানের ভুষি বিক্রি হত ১১৫০ টাকার উপরে। সেই হিসেবে, মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্যটির দাম প্রতিবস্তায় ২০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
দুই সপ্তাহ আগে বাজারে মাঝারি মানের প্রতিবস্তা গমের মোটা ভুষি বিক্রি হত ১০৩০ টাকা দরে। বস্তায় ১০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে একই মানের ভুষি ১১৩০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) গমের ভুষি বিক্রি হয়েছে ১১০০ টাকায়। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা দরে।
খামারিরা জানান, বর্তমানে বাজারে প্রতিবস্তা (৩০ কেজি) মসুরের ভুষি বিক্রি হচ্ছে ৮২০ টাকায়। যা মার্চের শেষ দিকে বিক্রি হত ৭২০ টাকার মধ্যে। আগে প্রতিবস্তা (৪০ কেজি) মুগডালের ভুষি ১১০০ টাকায় বিক্রি হতো। বস্তাপ্রতি ৮০ বেড়ে বাজারে এখন মুগডালের বিক্রি হচ্ছে ১১৮০ টাকায়।
মার্চের শেষ দিকে প্রতিবস্তা (৫০ কেজি) সয়াবিনের ভুষি (খোসা) ২৩০০ টাকায় পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা কিনতে হচ্ছে ২৩৮০ টাকা দরে। সেই হিসেবে, দুই সপ্তাহেই প্রতিবস্তা সয়াবিনের খোসার দাম বেড়েছে ৮০ পর্যন্ত।
এদিকে বস্তাপ্রতি (৪৮ কেজি ) ১০০ বেড়ে বর্তমানে ভুট্টা ভাঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ১০৫০ টাকা, মটরের খোসা বস্তাপ্রতি (১৮ কেজি) ১০০ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা ও চিড়ার গুড়া প্রতি বস্তায় (৪০ কেজি) ৫০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা ও শুকনা কড় (কেজিপ্রতি) ২ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮ টাকা দরে। মার্চের শেষ দিকে এসব পণ্যের মধ্যে ভুট্টা ভাঙ্গা ১০০০ টাকা, মটরের খোসা ৫০০ টাকা, চিড়ার গুড়া ৭০০ টাকা, ও শুকনা কড় ৬ টাকা দরে বিক্রি হতো।
চট্টগ্রাম নগরীর ঘাসিয়ার পাড়ার মেসার্স ইভা ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী আবু ইউসুফ বলেন, 'দিন দিন যেভাবে পশুখাদ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে খামার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। গত দুই সপ্তাহে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বস্তাপ্রতি ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও শ্রমিকের মজুরি দিয়ে বর্তমানে প্রতি লিটার দুধ উৎপাদনে খরচ পড়ছে প্রায় ৬৩ টাকা। কিন্তু বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে ৫৪-৫৭ টাকার মধ্যে। এমনকি লকডাউনে এই দামেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে আরো কম দামে মিল্কভিটায় দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে উদ্যোক্তারা'।
ডেইরি ফার্মের উদ্যোক্তরা জানান, খাদ্যের পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় পশু ওষুধের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। তাদের মতে, বর্তমানে বাজারে প্রতি প্যাকেট (৫ কেজি) ডিসিপি পাউডার (হাড়ের গুড়া) বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা দামে। যা দুই সপ্তাহ আগে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
দুই সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি মিনারেল পাউডার বিক্রি হতো ২৮০ টাকার মধ্যে। কেজিতে ৪০ টাকা বেড়ে এখন মিনারেল পাউডার বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা দামে।
বর্তমানে প্রতি প্যাকেট (৫ কেজি) তরল ক্যালসিয়াম বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকা দামে। যা দুই সপ্তাহ আগে ৯৫০-১০০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। একইভাবে ক্যালসিয়ামের প্রতিটি ইনজেকশনের দামও ৪০ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতিটি ক্যালসিয়াম ইনজেকশন বিক্রি হতো ৪৮০ টাকা দামে। যা এখন ৫২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
চিটাগাং ডেইরি ফার্ম এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ওমর বাবু জানান, 'পশুখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন খামারিরা। বছরের পর বছর এভাবে পশুখাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেক উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে খামার বন্ধ করে দিয়েছে। দেনার দায়ে অনেক খামারি গরু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন'।
দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে চাক্তাই এলাকার পাইকারি ডেইরি-পোল্ট্রি খাদ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হাজী জয়নাল আবেদীন স্টোরের স্বত্বাধিকারী হারুনুর রশিদ জানান, 'বাজারে যেই পরিমাণ পশুখাদ্যের চাহিদা রয়েছে উৎপাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেই পরিমাণে পণ্য সরবরাহ করে না। তাছাড়া আমদানিকৃত পণ্যের চেয়ে বাজারে চাহিদা বেশি থাকে। মূলত খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও আমদানিকারকদের কারসাজিতে পশুখাদ্যের দাম বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী'।
দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে এসিআই ফিডের টেরিটরি এক্সিকিউটিভ বেলাল হোসেন বলেন, 'করোনায় বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কারণে আর্ন্তজাতিক বাজার থেকে পোল্ট্রি ও ডেইরি ফিডের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে সয়াবিন ও সরিষার খৈলের দাম বৃদ্ধিতে ফিডের দাম কিছুটা বাড়াতে হয়েছে। তিনি আরো বলেন, শুধু এসিআই নয়, প্রায় প্রতিটি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানই পণ্যের দাম বাড়িয়েছে'।