হোম টেক্সটাইলের ক্রেতারা বাংলাদেশমুখী
কয়েক বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুরতে থাকা হোম টেক্সটাইল রপ্তানি হঠাৎ করেই আশার আলো দেখাতে শুরু করেছে বাংলাদেশকে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন ও পাকিস্তানের ক্রেতাদের একটি অংশ এখন বাংলাদেশমুখী হচ্ছেন। গত ছয় মাসের মধ্যে নতুন করে ইউরোপ ও আমেরিকার অন্তত আটটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছে, যারা আগে পাকিস্তান এবং চীন থেকে পণ্য ক্রয় করতো। প্রতিযোগিতামূলক দাম, অন টাইম ডেলিভারি, কোয়ালিটি নিয়ে ক্লেইম না থাকায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বায়ারদের মন জয় করতে শুরু করেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ বেশি সময় ঘরে থাকতে হওয়ায় বাসায় ব্যবহার্য টেক্সটাইলের ব্যবহারও বেড়েছে, ফলে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে বড় উল্লম্ফন দেখা গেছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তবে হোম টেক্সটাইলের মূল কাঁচামাল সূতার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি রপ্তানিকারকদের বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানিকারকদের দাবি, স্থানীয় স্পিনাররা কটনের দাম বাড়ার অজুহাতে দেশে দেশে এক ধরণের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সুতার দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সংকট সমাধানে স্থানীয়ভাবে ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে সুতা ক্রয় করা এ খাতের উদ্যোক্তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা বিদেশ থেকে সুতা আমদানির অনুমতি চেয়েছেন সরকারের কাছে। এছাড়া গ্যাস সংযোগ সহজেই না পাওয়া কিংবা পেতে বিপুল পরিমাণ বাড়তি টাকা খরচ করা এবং সাম্প্রতি বন্দরে জাহাজ সংকট এ খাতের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
এসব সংকট সমাধান করা গেলে হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে চলতি অর্থবছরেও বড় প্রবৃদ্ধির আশা দেখছেন রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল এন্ড লিলেন ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিটিটিএলএমইএ) এর তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে অন্তত আটজন নতুন বায়ার ব্যবসা শুরু করেছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা স্ট্যান্ডার্ড টেক্সটাইলও রয়েছে। বিটিটিএলএমইএ এর চেয়ারম্যান এম শাহাদাত হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠান টাওয়েল টেক্স সহ আরো একাধিক রপ্তানিকারকের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছে স্ট্যান্ডার্ড টেক্সটাইল। প্রতিষ্ঠানটি আগে পাকিস্তান থেকে হোম টেক্সটাইল আমদানি করতো। একইভাবে দেশের বৃহত্তম হোমটেক্সটাইল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপ এর দুটি হোম টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানের একটিতে সম্প্রতি নতুন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এসেছে।
এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, নতুন করে আরো কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে হোম টেক্সটাইল সামগ্রী ক্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
"বায়াররা পাকিস্তানের কাছে কমিটমেন্ট অনুযায়ী ঠিকমতো কোয়ালিটি পন্য পাচ্ছে না। আবার চীন অপেক্ষাকৃত লোয়ার এন্ডের পন্য উৎপাদন করে পোষাতে পারছে না। ফলে আমাদের সামনে ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।"
বিশ্বব্যাপী বর্তমানে হোম টেক্সটাইল মার্কেটের আকার ১০৪ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। আর ২০২৫ সাল নাগাদ তা ১৩৩ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। তৈরি পোশাকের মত চীন হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতেও ১ নম্বরে রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে এই পণ্যে এখনো বাংলাদেশের হিস্যা এক শতাংশের মতো।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ কারখানাই মধ্যম ও সাধারণ মানের হোম টেক্সটাইল আইটেম রপ্তানি করে। তবে এর মধ্যে নোমান টেরিটাওয়েল, জাবের এন্ড জুবায়ের ফেব্রিকস লিমিটেড, এসিএস টেক্সটাইল, শাহাব ফেব্রিকস লিমিটেড সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্যের হোম টেক্সটাইল আইটেম রপ্তানি করে।
এর মধ্যে মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ টাওয়েল ও ৫০ শতাংশ বেডিং। বেডিংয়ের মধ্যে রয়েছে বিছানার চাদর, বালিশ ও বালিশের কভার ইত্যাদি।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে ১.১৩ বিলিয়ন রপ্তানির মধ্যে এককভাবে নোমান গ্রুপ এর রপ্তানির পরিমাণ ৩২০ মিলিয়ন ডলার বলে জানিয়েছেন জাবের এন্ড জুবায়ের ফেব্রিকস লিমিটেড এর নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং) রাশেদ মোশাররফ।
বড় দুশ্চিন্তা সুতার দাম বৃদ্ধি ও গ্যাস প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা :
গত এক বছর ধরে ক্রমাগত সুতার দাম বৃদ্ধি এ খাতের উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। বর্ধিত দর বায়াররা দিতে চাইছেন না কিংবা খুবই সামান্য দিচ্ছেন। এখানেও পোশাক খাতের মত নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে ক্রয়াদেশ নেওয়ার প্রবণতায় অনেকে কম দরের অর্ডার নিতে বাধ্য হচ্ছেন। খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যে ধরণের টাওয়েলসহ হোম টেক্সটাইল সামগ্রী রপ্তানি করে তা তৈরি হয় মূলত ১০ কাউন্ট ও ১৬ কাউন্টের সুতা দিয়ে।
এম শাহাদাত হোসাইন জানান, গত ছয় মাসে ১৬ কাউন্টের সুতার দাম বেড়েছে ৭৮ শতাংশ আর ১০ কাউন্টের ৫৪ শতাংশ। তার অভিযোগ যে হারে তুলার দাম বেড়েছে, স্থানীয় বস্ত্রকল মালিকরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাড়তি দাম পাওয়া যাচ্ছে না।
চিঠিতে বলা হয়, টাওয়েল প্রায় ৭৫ শতাংশ খরচ হয় সুতার পেছনে। ফলে এই বর্ধিত দামে ক্রয় করে অনেকেই আয় ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে গত ২২ জুলাই সংগঠনটির পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে বন্ড লাইসেন্সবিহীন টেরিটাওয়েল কারখানার জন্য ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্রের মাধ্যমে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আলোচ্য দুই ধরণের সুতা আমদানির অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
যাদের বন্ড সুবিধা রয়েছে, তারাই কেবল রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় সুতা বা কাপড় আমদানি করতে পারে। আর ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে স্থানীয় বস্ত্রকল মালিকদের কাছ থেকে একই সুবিধায় সুতা ক্রয় করা যায়। কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়।
এছাড়া গ্যাস সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে নানান ঝক্কিও এ খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে।
বিটিটিএলএমইএ এর সভাপতি বলেন, যাদের একটি গ্যাস লাইন পেতে ঘাটে ঘাটে টাকা 'খরচ' করতে হয়। যে সংযোগ পেতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা লাগার কথা, তাতে ব্যয় হয়ে যায় ৩ কোটি টাকা। কেবল গ্যাসের জন্য এত টাকা দিয়ে কে বিনিয়োগে আসতে চাইবে? তিনি বলেন, সহজে ও সরকারি ব্যয়ে গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত হলে এ খাতে আরো অনেকেই বিনিয়োগে আসতে চাইবে।