১৮০ বিলিয়ন ডলারের টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বাজার অধরা বাংলাদেশের
বিশ্বব্যাপী টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বাজারের আকার এখন প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের সামনে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, বলতে গেলে এই বাজার এখনও অধরা। এর পেছনে রয়েছে মূলত পাঁচটি কারণ- বাজারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, উচ্চ-কর্মক্ষম কাঁচামালের অভাব, কমপ্লায়েন্স ও সার্টিফিকেশন এবং মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা।
"ফিজিবিলিটি স্টাডি অন স্কেলিং আপ দ্য প্রোডাকশন অব টেকনিক্যাল টেক্সটাইল (টিটি) ইনক্লুডিং পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ইন বাংলাদেশ" শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ এখনো টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এই পণ্যের বড় ক্রেতা ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার ধরার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছে জর্মানভিত্তিক সংস্থা 'গিজ' (ডয়েচে গেজেলেশাফ্ট ফুয়ের ইন্টারন্যাশিওনালে সুজামেনারবাইট- জিআইজেড)। মঙ্গলবার পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণাটি প্রকাশ করবে জার্মানভিত্তিক এই সংস্থা।
টেকনিক্যাল টেক্সটাইলে সাধারণত নান্দনিক উদ্দেশ্যে পণ্য তৈরি করা হয় না। এখানে কার্যক্ষমতাই হল পণ্যের প্রাথমিক মানদণ্ড। বর্তমানে, প্রযুক্তিগত বা টেকনিক্যাল টেক্সটাইল উপকরণগুলো ফিল্টার পোশাক, আসবাবপত্র, স্বাস্থ্যবিধি ও চিকিৎসা এবং নির্মাণ সামগ্রীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি মাস্ক এবং পিপিইও টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের অন্তর্ভুক্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের অধিকাংশ পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের আকারই মাঝারি ধরনের। এমনকি টিটি/পিপিই পণ্যের বড় পোশাক গোষ্ঠীগুলো আন্তর্জাতিক ক্রয় সংস্থাগুলোর কাছে পরিচিত নয়। এছাড়া, মেডিকেল পিপিই পণ্যের সোর্সিং সাপ্লাই চ্যানেল তৈরি পোশাকের তুলনায় অনেক বেশি জটিল। তাই ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর জন্য পণ্যের কার্যক্ষমতা, পরীক্ষা এবং সনদ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন।'
ধারণা করা হচ্ছে, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ২২৪.৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে, যেখানে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার হবে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। আবার এদিকে, বিশ্বব্যাপী পিপিই-এর বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে ৯৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলেও অনুমান করা হচ্ছে।
এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো'র (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে ৬১৮ মিলিয়ন ডলারের মাস্কসহ পিপিই রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি। এর বাইরে অন্যান্য টেকনিক্যাল টেক্সটাইল পণ্য কী পরিমাণ রপ্তানি হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি।
তবে পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, বাংলাদেশ এখনও তার ০.৫ শতাংশও রপ্তানি করতে পারছে না। অথচ তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবদান ৬ শতাংশেরও বেশি। পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, তাদের সদস্যভুক্ত ১৫৫টি প্রতিষ্ঠান মাস্ক ও পিপিই রপ্তানি করে থাকে। এর মধ্যে বিশ্বের ১৯টি দেশে মাস্ক ও ৬টি দেশে পিপিই রপ্তানি করা হচ্ছে।
কাঁচামাল সংগ্রহ এবং পণ্যের গুণমান পরীক্ষা বা সনদের মান সংক্রান্ত জটিলতাকে গবেষণায় বাংলাদেশের টেকনিক্যাল টেক্সটাইল রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিজিএমইএ'র পরিচালক আব্দুল্লাহিল রাকিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বিশ্ববাজারে আমাদের টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের রপ্তানি নেই বললেই চলে। কোভিড শুরু হওয়ার পর অনেকটা বাধ্য হয়েই আমরা তা শুরু করেছি। টেকনিক্যাল টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে কাঁচামালের যোগান ও অর্ডার পাওয়ার নিশ্চয়তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ এখনও এই পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বব্যপী স্বীকৃতি পায়নি।"
তিনি আরও বলেন, "তবে আমাদের কিছু পিপিই আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন পেতে শুরু করেছে। ফলে এখানে ভবিষ্যতের জন্য বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এই বাজারের ১০ শতাংশ ধরতে পারলেও আমাদের মোট পোশাক রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতো।"
বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এখন থেকে সাধারণ পোশাকের বাইরে উচ্চ মূ্ল্যের বা ব্যাতিক্রমধর্মী পোশাক তৈরিতে উৎসাহ দিচ্ছি। তবে যারা এ ধরনের উদ্যোগ নেবে, তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রণোদনা থাকা দরকার।"
কীভাবে বাংলাদেশ এ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে ভালো করতে পারে, তার একটি উপায়ও বলে দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, উৎপাদনের প্রথমিক পর্যায়ে, বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলে সীমিত সংখ্যক সুপ্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তিগত পোশাক প্রস্তুতকারকের দ্বারা সীমিত সংখ্যক পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ের এই কৌশল টিটি/পিপিই ক্লাস্টারের একটি সম্পূর্ণ রোল মডেল হিসেবে কাজ করবে।
শক্ত একটি ভিত তৈরি করতে সবকিছু একটি ছোট পরিসরেই শুরু করতে হবে; এবং এরপর চাহিদা সাপেক্ষে দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
প্রাথমিক পর্যায়ে, দক্ষতার সঙ্গে উৎপাদনের জন্য কারখানাগুলোকে প্রযুক্তিগতভাবে আরও উন্নত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ উপযুক্ত কাঁচামাল সংগ্রহ এবং মানসম্মত উৎপাদন নিশ্চিত করবে। এছাড়া, অন্যান্য বিভাগ পণ্যের গুণমান পরীক্ষা এবং সনদের মান ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ নেবে। বাংলাদেশ একবার নতুন এই পণ্যখাতে সুনাম, আত্মবিশ্বাস এবং নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করতে পারলেই, ধীরে ধীরে আরও বৈচিত্র্যময় এবং অত্যাধুনিক পণ্যের উৎপাদনে মনোযোগ দিতে পারবে; এবং এভাবে পরবর্তীতে মুনাফার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে।
সীমিত সংখ্যক পণ্য দিয়ে শুরু করেও, যদি সেগুলো মানসম্মতভাবে উৎপাদন করা হয়, তাহলে এটি অন্যান্য নতুন পণ্য এবং বাজারের দরজা খুলে দেবে। প্রারম্ভিক নির্মাতাদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে, আরও অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান এই খাতে ব্যবসা করতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মেডিকেল টেক্সটাইল পণ্য আমদানি করে ইউরোপ। তবে, উত্তর আমেরিকাতেও এই ধরনের পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং বাড়তে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ পৃথিবীতে টেকনিক্যাল টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা ও ব্যবহার অফুরন্ত হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একবার নির্মাতারা নির্ভরযোগ্য সামগ্রী সরবরাহ করতে পারলে, তাদের উৎপাদন কার্যক্রম উন্নত করতে পারলে এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং সনদে পণ্যের মান ধরে রাখার পদ্ধতি শিখে নিতে পারলেই, সামনে রয়েছে পণ্য বৈচিত্র্যের বিশাল সুযোগ।"
এছাড়া, বাংলাদেশ ইইউ'র 'অস্ত্র ছাড়া সবকিছু (ইবিএ)' বা 'এভ্রিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)' পরিকল্পনা থেকেও শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা পেয়ে থাকে।
- প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: $180b technical textile market still eludes Bangladesh