১৯ লাখ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি ৪ বছর ধরে আটকে আছে শিউরক্যাশ চক্করে
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বিধিবিধান গুরুতর লংঘন করে ব্যবসা পরিচালনা করছে রাষ্ট্রায়ত্ব রূপালী ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান শিউরক্যাশ। এমএফএস অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহকের পরিচয় নিশ্চিত করতে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি সচল গ্রাহকের এনআইডির তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি অনেক সচল এজেন্টের হিসাবেও এনআইডি ব্যবহার হয়নি।
আবার, একটি এনআইডির বিপরীতে একটি অ্যাকাউন্ট খোলার নিয়ম থাকলেও তিন লাখেরও বেশি এনআইডির বিপরীতে একাধিক হিসাব সচল রয়েছে।
শিউরক্যাশের সিস্টেম প্ল্যাটফর্মে একই এনআইডির বিপরীতে একাধিক হিসাব খোলা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থাও নেই।
এসব তথ্য পাওয়া গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে। ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করা শিউরক্যাশের বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এজেন্টের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার।
আরও ভয়ংকর তথ্য হলো, শিউরক্যাশের প্রায় ১৯ লাখ হিসাব পেন্ডিং অবস্থায় রয়েছে, যাতে স্থিতির পরিমাণ ১২০ কোটি টাকা। এই টাকার বড় অংশই প্রাইমারি শিক্ষার্থীদেরকে দেওয়া সরকারি বৃত্তির টাকা। চার বছর ধরে এসব অ্যাকাউন্ট পেন্ডিং থাকায় শিক্ষার্থীরা টাকা তুলতে পারছে না।
উপবৃত্তির টাকা যে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না, তা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে যথাযথভাবে অবহিতও করেনি শিউরক্যাশ।
পরিদর্শন প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে শিউরক্যাশের আইন ভঙ্গের বিষয়গুলো নিয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাখ্যা দেওয়ার কথা থাকলেও শিউরক্যাশ থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে এখনো জবাব দিতে পারেনি রূপালী ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনটি গত ৪ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের কাছেও পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শিউরক্যাশের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) ড. শাহাদাত খানের সঙ্গে কথা বলে পরিদর্শন রিপোর্টে উল্লেখ করা সব ধরনের অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে এসব অনিয়মের দায় নিতে নারাজ শিউরক্যাশ। তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এমএফএস গাইডলাইন জারি করার আগে এসব অনিয়ম হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) শাহাদাত খান বলেন, 'আমরা প্রতি বছর ১ কোটি শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা পাঠাই। এক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য ৯৮ ভাগেরও বেশি। এত শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮ লাখ হিসাব বড় কিছু নয়। আমরা বছরে ১২০০ কোটি টাকা উপবৃত্তি বিতরণ করি। সেখানে চার বছরে ১২০ কোটি টাকা পেন্ডিং থাকা বড় কিছু নয়।'
তিনি বলেন, গ্রামে-গঞ্জে অনেকে ফিচার ফোন ব্যবহার করে। উপবৃত্তির টাকা পাঠানোর এসএমএস যাওয়ার পর কোনো কারণে তা ডিলিট হয়ে গেলে, তারা মনে করে ওই টাকা আর পাওয়া যাবে না। সে কারণেই শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির টাকা তুলছে না। তাছাড়া, অনেক পরিবার উপবৃত্তির টাকা তুলে খরচও করতে চায় না।
হিসাব পেন্ডিং করার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা অনুরোধ করলে শিক্ষার্থীদের হিসাব পেন্ডিং রাখা হয়। কারও সিম হারিয়ে বা নষ্ট হয়ে গেলে প্রধান শিক্ষক হিসাব হেন্ডিং রাখার অনুরোধ করেন।
নিয়মানুযায়ী পেন্ডিং হিসাবে শুধু ক্যাশ ইন এবং মোবাইল রিচার্জ বাদে অন্য কোনো ধরনের লেনদেনের সুযোগ নেই। কিন্তু শিউরক্যাশের পেন্ডিং হিসাব থেকে প্রাইভেট টু বিজনেস ও ক্যাশ-আউট হয়েছে প্রায় ৭৬ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে শাহাদাত খান বলেন, হিসাবগুলো পেন্ডিং করার আগেই এ টাকা তুলে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।
এক-চতুর্থাংশেরও বেশি একাউন্টে এনআইডি নেই
কোম্পানিটির প্রায় দুই কোটি কাস্টমার অ্যাকাউন্টের মধ্যে প্রায় ৫৯ লাখ সচল অ্যাকাউন্টের বিপরীতে কোনো এনআইডি নেই বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু গ্রাহকই নয়, দিনভর লেনদেনকারী এজেন্টদের মধ্যেও প্রায় ১০ হাজার অ্যাকাউন্টের বিপরীতে কোনো এনআইডি পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিউরক্যাশের সিইও ড. শাহাদাত খান বলেন, 'অ্যাকাউন্টের বিপরীতে এনআইডি না থাকার দায় রূপালী ব্যাংকের। কাস্টমারের কেওয়াইসি করার দায়িত্ব রূপালী ব্যাংকের। কেওয়াইসি করতে শিউরক্যাশ কোনো অর্থ খরচ করতে রাজি নয়। আমরা শুধু সফটওয়্যার সাপোর্ট দিচ্ছি।'
তিনি বলেন, 'প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষার্থীদের মোবাইল নম্বর, নাম-ঠিকানার তালিকা আমাদের দিয়ে ওইসব নম্বরে উপবৃত্তির টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে। রূপালী ব্যাংক আমাদের বলেছে, সরকারের তালিকা মানেই এক ধরনের কেওয়াইসি। আমরা সেই তালিকা ধরে টাকা পাঠিয়েছি। সেখানে কার এনআইডি আছে, কার নেই তা যাচাই করা হয়নি।'
৩.১৭ লাখ এনআইডিতে একাধিক অ্যাকাউন্ট
একটি এনআইডির বিপরীতে একটি হিসাব খোলার নিয়ম থাকলেও ৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৯৩টি এনআইডির প্রতিটির বিপরীতে একাধিক হিসাব খোলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্টে বলা হয়েছে, একই এনআইডির বিপরীতে একাধিক হিসাব খোলা প্রতিরোধের সিস্টেমই নেই শিউরক্যাশের।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে শিউরক্যাশের সিইও বলেন, 'আমাদের সিস্টেমে কোনো ত্রুটি নেই। একজন গ্রাহক শুরুতে একটি এনআইডি ব্যবহার করে একটি হিসাব খুলেছে। সে সময় হয়তো সে এনআইডি নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে ভুল করেছে। দ্বিতীয়বার সে সঠিক এনআইডি নম্বর ব্যবহার করে আরেকটি হিসাব খুলেছে। তাই আমাদের সিস্টেম ধরতে পারেনি।'
জাতীয় তথ্যভাণ্ডার থেকে গ্রাহকের তথ্য যাচাই করা হলে কীভাবে এমন ভুল হতে পারে, জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংক শিউরক্যাশের ৩৭ জন গ্রাহকের হিসাবে নেগেটিভ ব্যালেন্স পেয়েছে। অর্থাৎ হিসাবে যে পরিমাণ স্থিতি ছিল, তার চেয়ে বেশি টাকা ক্যাশ-আউট বা লেনদেন করেছে গ্রাহক। এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেন শিউরক্যাশের সিস্টেম ডিজাইনে বড় ধরণের ত্রুটি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শিউরক্যাশের সিইও বলেন, 'অ্যাকাউন্টগুলোতে এক-দেড় টাকার মতো নেগেটিভ ব্যালেন্স ছিল। দুই কোটি গ্রাহকের একটি সিস্টেম পরিচালনাকালে এমন কিছু সমস্যা হতেই পারে। তবে এ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।'
'শিউরক্যাশের ওপর রূপালী ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই'
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিউরক্যাশের সিস্টেম হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও ডাটাবেজের ওপর রূপালী ব্যাংকের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ব্যবসার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, লেনদেনের সর্বোচ্চ সীমা এবং মোবাইল ওয়ালেটে সর্বোচ্চ স্থিতি সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও গাইডলাইনও অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না।
এমএফএস রেগুলেশন্স অনুযায়ী দিনশেষে ই-মানি, নগদ অর্থের সমান বা কম থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সরেজমিন পরিদর্শনকালে তার ব্যত্যয় দেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে, এজেন্ট ওয়ালেট এবং ডিস্ট্রিবিউটর ওয়ালেট ইস্যু করা ই-মানির বিপরীতে দিনশেষে জমা হওয়া নগদ অর্থের পরিমাণে প্রায় ৫ কোটি টাকারও গরমিল পাওয়া গেছে।
পরিদর্শন রিপোর্টে এ ধরনের ঘটনাকে 'অবৈধ অর্থ সরবরাহের শামিল এবং গুরুতর অনিয়ম' বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিজেদের সাবসিডিয়ারি হওয়া সত্ত্বেও শিউরক্যাশের নিয়ন্ত্রণ না থাকার কথা স্বীকার করেছেন রূপালী ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তারা।
ব্যাংকের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুম অসুস্থ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (মোবাইল ব্যাংকিং) মো. মনিরুল হক টিবিএসকে বলেন, শিউরক্যাশ প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক রূপালী ব্যাংককে এনওসি দিয়েছে। তবে কোম্পানিটির ওপর রূপালী ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
তিনি জানান, 'শিউরক্যাশে সংঘটিত অনিয়ম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে বলেছে। সফটওয়্যার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানতে তখন থেকে আমরা শিউরক্যাশের পেঁছনে ঘুরছি। তাদের সঙ্গে একটা মিটিংও করেছি। তারা কিছু ডকুমেন্ট দেবে বলে কথাও দিয়েছিল। কিন্তু এখনো দেয়নি।'
মনিরুল হক বলেন, 'বুধবার (৬ জানুয়ারি) শিউরক্যাশ আমাদের মৌখিকভাবে জানিয়েছে, তথ্য দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্ত্রী কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ওই কর্মকর্তা আইসোলেশনে আছেন। তাই ডকুমেন্ট দিতে তাদের এক-দুই সপ্তাহ সময় লাগবে।'
রূপালী ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি হিসেবে ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু করে শিউরক্যাশ। বর্তমান প্রতিষ্ঠানটির প্রায় দুই কোটি গ্রাহক এবং প্রায় দুই লাখ এজেন্ট রয়েছে। বেসরকারিখাতের ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিয়ে থাকে কোম্পানিটি।
গবেষণা সংস্থা 'বিজনেস হান্ট'-এর তথ্য অনুযায়ী, বিকাশ, রকেট ও নগদের পর শিউরক্যাশ দেশের চতুর্থ বৃহত্তম এমএফএস প্ল্যাটফর্ম।