২০২০-২১ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালো তৈরি পোশাক রপ্তানি
করোনা ভাইরাস সৃষ্ট কঠিন সময়েও পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখেছে বাংলাদেশ। সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সূত্র অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) নির্ধারিত ৩০.৭৬ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম হয়েছে ।
সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩০.৮৬ বিলিয়ন ডলার। ইপিবির গত বছরের পরিসংখ্যানের বিবেচনায় সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বা প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে রপ্তানির হিসাব করেছে বিজিএমইএ। তবে রপ্তানির হিসাব প্রকাশকারী প্রতিষ্ঠান ইপিবি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেনি।
করোনা ভাইরাসের কঠিন পরিস্থিতিতেও তৈরি পোশাক রপ্তানির এমন চিত্রে আশাবাদী রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্টরা। পোশাক রপ্তানিকারকরা আগামী মাসগুলোতে ভালো রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছেন।
মূলত ভারত, চীন ও মায়ানমার থেকে কিছু রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে আসতে শুরু করায় এখন কারখানাগুলোর কাজ বেড়েছে। তবে, পোশাকের প্রধান কাঁচামাল তুলার দাম এবং পরিবহনসহ ফ্রেইট খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। এর সঙ্গে ক্রমাগত পোশাকের দর কমে যাওয়ায় রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন।
বিজিএমইএ'র সহ সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রপ্তানি আদেশ বাড়ছে। মূলত চীন, ভারত ও মায়ানমার থেকে সরে আসা কিছু অর্ডার আমরা পাচ্ছি। এর সঙ্গে গত কয়েক বছরে তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে আমরা যে ঈর্ষণীয় উন্নতি করেছি, তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের আস্থা বাড়ছে। ফলে, ওয়াল্ট ডিজনির এর মত প্রতিষ্ঠান আট বছর পর বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য আসার ঘোষণা দিয়েছে।"
অবশ্য রপ্তানি বাড়লেও এর সঙ্গে ক্রমাগত পোশাকের দাম কমে যাওয়া নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বিজিএমইএর সহ সভাপতি ও অন্যতম বড় ওভেন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক গ্রুপের এই কর্ণধার। একইসঙ্গে, যে সব ক্রেতা নতুন করে বাংলাদেশের আসছে, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা করার সূচকে প্রত্যাশিত অগ্রগতি করতে না পারায় তাদের ধরে রাখা যাবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন তিনি।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর রপ্তানি কমতে থাকে ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশেই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু করোনার ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৮.২ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে পোশাক রপ্তানি হয় মাত্র ২৭.৯৫ বিলিয়ন ডলার।
এর আগে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ২৭.৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় রপ্তানি কমে যায় ১৮ শতাংশেরও বেশি।
অবশ্য বিজিএমইএ বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি হয়েছিলো ২৬.৫৭ বিলিয়ন ডলার। ফলে বিজিএমইএ'র তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৬ শতাংশের কিছু বেশি।
এদিকে বিজিএমইএ আশা করছে, নতুন করে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি হতে পারে ৩৩.৭ বিলিয়ন ডলার। যদিও সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে প্যান্ডেমিক শুরু হওয়ার আগের অর্থবছরের (২০১৮-১৯) রপ্তানিকে অতিক্রম করবে বলে আশার কথা জানিয়েছেন।
তবে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহ সভাপতি ফজলে শামীম এহসান চলতি অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি মহামারি পূর্ব সময়ের চেয়ে বেশি হতে পারে বলে আশার কথা জানিয়েছেন।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, যদি কোভিড পরিস্থিতির অবনতি না হয়, তাহলে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের নিটওয়্যার পোশাক রপ্তানি বাড়বে ১৫ শতাংশ। তবে ফ্রেইট খরচ প্রায় ১৫০ শতাংশ ও কাঁচামালের দাম ১৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার ফলে রপ্তানি বাড়লেও দেশের সার্বিক আয় কমে যাবে।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রপ্তানির অর্জন ইতিবাচক হলেও তা এখনও মহামারি পূর্ব পর্যায়ে যেতে পারেনি। অর্থাৎ বলা যায়, এখন পর্যন্ত পুনরুদ্ধার পর্যায়ে রয়েছে। তবে, আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রপ্তানি বাড়লেও কারখানা মালিকরা ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিলেন, সে তুলনায় তা হতাশাজনক। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সে অবস্থায় যেতে আরো পাঁচ বছরের মত লেগে যাবে। "
তবে কেবল সাধারণ মানের পোশাক তৈরি করে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়লেও তাতে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশিত দর পাবেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমাদের কটন নির্ভর পণ্য থেকে ম্যান মেড বা কৃত্রিম ফাইবারে যেতে হবে।"
উচ্চ ভ্যালুসম্পন্ন পণ্যে যেতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার ধরতে পারবে বলে আশার কথা জানান তিনি।
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পরের বছর বিজিএমইএ ২০২১ সাল নাগাদ ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলো।
প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাপী পোশাক বাজারের ৭০ শতাংশের উপরে ম্যান মেড বা কৃত্রিম ফাইবারের হলেও বাংলাদেশে কটন ভিত্তিক পোশাক পণ্য এখনও ৭০ শতাংশের বেশি।
বিজিএমইএ সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম মনে করেন, কৃত্রিম ফাইবারে যেতে পারলে ভ্যালু অ্যাড বর্তমানের তুলনায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে।