‘শান্তিতে মরতে’ পারছে না রুগ্ন ১৩৩ পোশাক কারখানা
নিজেদের ব্যাংক ঋণের দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে এখনই 'শান্তিতে মরতে' পারছে না তৈরি পোশাকখাতের রুগ্ন ও বন্ধ কারখানাগুলো। এজন্য কারখানাগুলো তাদের কাছে পাওনা ব্যাংকের ৬৮৬ কোটি টাকার দায় থেকে মুক্তি চেয়েছিল।
কিন্তু কোভিডের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এই দায় থেকে এখন অব্যাহতি দেওয়া সম্ভব নয় বলে মতামত দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
তবে ঋণের দায় থেকে মুক্তি না পেলেও কিছুটা স্বস্তি পেতে যাচ্ছেন তৈরি পোশাকখাতের প্রথম দিককার এসব কারখানার মালিকরা। তাদের বিরুদ্ধে জারি হওয়া অর্থঋণ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও সম্পত্তি ক্রোক করার কার্যক্রম স্থগিত রাখা হতে পারে।
এজন্য অর্থমন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়ার সুপারিশ করেছে '১৩৩ রুগ্ন ও বন্ধ তৈরি পোশাক কারখানার ঋণ হিসাব অবসায়নে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি'।
কমিটি গত ৬ জানুয়ারি বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিনের কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়। গত বছরের ২৭ অক্টোবর এ কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কমিটি এসব কারখানার ঋণ হিসাব পর্যায়ক্রমে অবসায়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থবিভাগকে অনুরোধ জানানোর সুপারিশ করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন অতিরিক্ত সচিব নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কমিটির আহ্বায়ক ইতোমধ্যে পিআরএলে চলে গেছেন। তবে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আমরা অর্থবিভাগে শিগগিরই চিঠি পাঠাবো'।
১৯৮৫ সাল থেকে পোশাকখাতের রুগ্ন ও বন্ধ হওয়া ২৭৯টি কারখানাকে এক্সিট সুবিধা দিয়েছিল সরকার। ওই সময় ১৩৩টি কারখানা মালিক এ সুবিধা নেননি। পরে ঋণদাতা ব্যাংকগুলো তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করলে বেশকিছু ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন আদালত।
এসব কারখানা মালিকের বকেয়া ঋণ মওকুফ চেয়ে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক গত বছর সেপ্টেম্বরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে আবেদন জানান।
আবেদনের বিষয়ে মতামত চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানায়, ১৩১টি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের মূল ঋণের পরিমাণ ৫৫২.৫৩ কোটি টাকা, আয় খাতে নেওয়া সুদের পরিমাণ ১৪৭.০৫ কোটি টাকা ও ব্যাংকগুলোর মামলা খরচ ৩.৫৭ কোটি টাকা।
অন্য দুটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, 'প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ মওকুফ করতে চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে মোট ৬৮৬.৩২ কোটি টাকা পাওনা পরিশোধ করতে হবে। সুদ মওকুফ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী, সরকার চাইলেও কস্ট অব ফান্ড ও আয় খাতে নেয়া সুদ মওকুফ করা যাবে না।'
পরে বিশেষ বিবেচনায় এসব রুগ্ন শিল্পের ঋণ মওকুফের জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছেও আবেদন করে বিজিএমইএ। এ প্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিষয়টি পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেওয়ার জন্য কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
দুই মাসের মধ্যে সুপারিশসহ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। কমিটি দুটি বৈঠক করে প্রতিবেদন জমা দেয়।
কারখানাগুলো রুগ্ন হওয়ার কারণ হিসেবে কমিটি বলেছে, এগুলো ভাড়াবাড়িতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে। ব্যাংকিং নিয়ম-কানুন, আন্তর্জাতিক ব্যবসার নিয়ম-কানুন অধিকাংশ উদ্যোক্তারই অজানা ছিল।
নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, বাড়িভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল পরিশোধেও অসমর্থ্য হয়ে পড়ে। এজন্য রুগ্ন ও বন্ধ এসব কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
বৈশ্বিক মন্দায় ওয়ার্ক অর্ডার কমে যাওয়া, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্য সময়মত জাহাজীকরণে ব্যর্থ হওয়ায় এসব কারখানা মালিকরা ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। বকেয়া বাড়ি ভাড়া ও ইউটিলিটি বিলের কারণে মেশিনারিজ নিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য ২০১২ সালে সরকারের দেওয়া এক্সিট সুবিধা নিতে সেগুলো অসমর্থ হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
কমিটিতে থাকা অর্থবিভাগের প্রতিনিধি জানান, তৈরি পোশাকখাতের অবদান বিবেচনায় নিয়ে সরকার কোভিড পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গার্মেন্টস খাতে সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। অতীতে এ ধরণের ঋণ মওকুফ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়টি নিষ্পত্তির উপযুক্ত সময় নয় বলে মত দেন তিনি।
এদিকে, গত ৫ নভেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রথম বৈঠকের পর বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক কমিটির আহ্বায়ক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (রপ্তানি) মো. ওবায়দুল আজমের কাছে চিঠি পাঠান।
চিঠিতে রুবানা হক লিখেন, ১৩৩টি কারখানা যখন রুগ্ন হয়ে পড়ে, তখন কারখানার সাথে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বৈদেশিক লেনদেন, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণপত্র, ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা বন্ধ করে দেয়।
একইসঙ্গে শ্রমিকদের মজুরিসহ কারখানার অত্যাবশকীয় ও প্রয়োজনীয় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেওয়া থেকেও বিরত থাকে। এতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সকল কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
তখন কারখানাগুলো শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারেনি। নিদারুণ অর্থসংকটের কারণে কারখানার বৈদ্যুতিক বিল, গ্যাস বিল ও অন্যান্য সার্ভিস লাইনের বিলগুলো সময়মতো পরিশোধ না করার কারণে সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
চিঠিতে তিনি বলেন, ঋণখেলাপি হয়ে পড়ায় তারা নতুন ব্যাংকঋণ পায়নি। বকেয়া ভাড়ার কারণে বাড়ির মালিকরা কারখানার মেশিনারিজ দখল করে নেয়। ঋণদাতা ব্যাংকগুলো দখলে নেয় কারখানার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি।
চিঠিতে আরও বলা হয়, তাদের শেষ ভিটে বাড়িও ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ করা এবং যে কোনো সময় নিলাম করে নিঃস্ব মালিকদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দিতে পারে। অর্থঋণ আদালতে মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি হিসেবে ফেরারি জীবনযাপন করছেন তারা।
রুবানা হক বলেন, রুগ্ন এই ১৩৩ কারখানার সার্বিক অবস্থা খুবই করুণ। মালিকদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। বাকিরা বয়সের ভারে শারিরীক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এ অবস্থায় রুগ্ন শিল্প মালিকদের পক্ষে কারখানা চালু বা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।