ঈদে ব্যবসা হারানোর আশঙ্কায় অনাদায়ী ট্যানাররা
আসছে কুরবানির ঈদ। এই কুরবানিতে চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে শঙ্কিত সাভার চামড়া শিল্প নগরীর উদ্যোক্তারা।
মূলত, ট্যানারির পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়া, রি-নিউ না করা ও ট্যানারির জমির লিজ ডিড সম্পন্ন না হওয়ায় কুরবানির ঈদে চামড়া নিয়ে শঙ্কার কথা বলছেন উদ্যোক্তারা।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, কমপ্লায়েন্সের কারণে নতুন করে ছাড়পত্র দিচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। আবার যারা ছাড়পত্র পেয়েছিল, তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ ছাড়পত্র রি-নিউ করা হচ্ছে না।
সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়ায় চামড়া প্রক্রিয়াকরণের প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল আনা যাচ্ছে না। বন্ড লাইসেন্সও রি-নিউ করা যাচ্ছে না।"
তিনি বলেন, "ঈদ চলে এসেছে কিন্তু বিষয়গুলোর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। কেমিক্যাল আনতে না পারলে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ বাধাগ্রস্ত হবে। ছাড়পত্র না দিলে অনেক ট্যানারি বন্ধও করে দিতে হবে।"
আবার ট্যানারির লিজ ডিড সম্পন্ন না হওয়ায় জমির বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণও নিতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে ট্যানারি মালিকদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকট দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, "কমপ্লায়েন্স মেনে ব্যবসা করছে এমন ৪০টির মতো ট্যানারি রয়েছে। তারা পরিবেশের কোনো দূষণ করছে না, তাদের লিজ ডিড সম্পাদন করা প্রয়োজন।"
সম্প্রতি 'চামড়া শিল্পখাতের উন্নয়নে সুপারিশ প্রদান ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন টাস্কফোর্স' কমিটির এক সভায় বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেসব ট্যানারির কমপ্লায়েন্স ভালো তাদের লিজ ডিড সম্পাদন করা হবে।
অর্থাৎ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মতে, যেসব ট্যানারি পরিবেশ কমপ্লায়েন্স মেনে চলছে, তাদের জমির লিজ ডিড সম্পাদিত হবে।
বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে রাজধানীর হাজারীবাগে গড়ে উঠা ট্যানারিগুলোকে ধলেশ্বরীর নদীর তীরে সরিয়ে নিয়ে পরিকল্পিত চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়।
বহুল আলোচিত ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাস্তবায়িত সাভার ট্যানারি শিল্পপার্কের সলিড ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ। এছাড়া, ট্যানারির বর্জ্যে পরিবেশ ও নদী দূষণের ঘটনাও ঘটছে।
অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলায় ধলেশ্বরী নদীর পানি দূষণ ঘটছে, যার কারণে এখনো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি ট্যানারি শিল্পপার্কের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি)।
পরিবেশ দূষণের কারণে এই শিল্পপার্কটি বন্ধের সুপারিশও করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
লিজ ডিড
২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে সরিয়ে নেওয়া হয়।
মালিকদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরিয়ে নেওয়ার কারণে জমির লিজ ডিড ছাড়াই কারখানা স্থাপনের সুযোগ দেয় সরকার।
প্রকল্প চলমান থাকায় প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিতে জমির দাম নির্ধারণ নিয়ে জটিলতায় মালিকরা লিজ ডিড সম্পন্ন করেনি।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, দফায় দফায় সাভার ট্যানারি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে খরচের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এতে প্রতি বর্গফুট জমির দাম ৪৯৯ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০০ টাকা।
তবে জোরপূর্বক স্থানান্তরের কারণে উদ্যোক্তাদের চাওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার জমির মূল্যের উপর ৮০ শতাংশ ছাড় দেয়।
গত বছরের ৩০ জুন প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন।
প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় এককালীন দাম পরিশোধের মাধ্যমে জমির লিজ ডিড সম্পন্ন করার সুযোগ দেয় বিসিক।
তবে করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় ২৫০টির মধ্যে মাত্র ১০-১৫টি প্রতিষ্ঠান মূল্য পরিশোধ করে লিজ ডিড সম্পন্ন করেছে। বাকিরা এখনো টাকা পরিশোধ করেনি।
পাঁচ বছর মেয়াদে দশ কিস্তিতে ফি পরিশোধ করলেই লিজ ডিড সম্পন্ন হওয়ার কথা।
মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, "জমির লিজ ডিড সম্পাদন হওয়া খুব জরুরী। প্লট বরাদ্দ পেয়ে কারখানা স্থাপন করা হলেও এখনো এই ডিড সম্পন্ন হয়নি। যার কারণে উদ্যোক্তারা এই জমির বিপরীতে কোনো ঋণ নিতে পারছে না।"
মো. শাহীন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "পরিবেশ ছাড়পত্র পাচ্ছি না, আবার লিজ ডিডও হচ্ছে না। এই নিয়ে বিপাকে রয়েছে ট্যানারি মালিকরা।"
তিনি বলেন, "লিজ ডিড না থাকায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কুরবানি ঈদের সময় ট্যানারি মালিকদের বড় ধরনের অর্থের প্রয়োজন হবে। লিজ ডিড থাকলে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যেতো, বিষয়টির সুরাহা হওয়া প্রয়োজন।"
পরিবেশ ছাড়পত্র না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, "কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় ট্যানারিগুলোর জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র দিচ্ছে না। বিষয়টা অনেকটাই এরকম, সিইটিপির দোষ চাপানো হচ্ছে ট্যানারি মালিকদের উপর।"
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ ওই সভায় বলেন, "সারফেস ড্রেন দিয়ে ক্রোমিয়াম মিশ্রিত পানি নদীতে ফেলা হচ্ছে। কঠিন বর্জ্যও বিনা অনুমতিতে বাইরে চলে যাচ্ছে।"
তিনি সিইটিপি ও ট্যানারি সমূহকে পরিবেশ আইন অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স অর্জনে আরও আন্তরিক হওয়ারও অনুরোধ জানান।
লিজ ডিড প্রসঙ্গে বিসিকের চেয়্যারম্যান মুহাম্মদ মাহবুবর রহমান জানান, "কমপ্লায়েন্স অর্জন না করলে ট্যানারি মালিকদের লিজ ডিড দেওয়া বিধিসম্মত হবে না।"
সিইটিপি-র বর্তমান অবস্থা
সর্বশেষ ডিওই রিপোর্টে দেখা গেছে, কমন অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি)তে বর্জ্য নিষ্কাশন স্বীকৃত প্যারামিটারের চেয়েও বেশি।
যদিও বিএসসিআইসি দাবি করে, সিইটিপি প্রতিদিন ২৫ হাজার কিউবিক মিটার ধারণ করতে পারে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর প্রকৃত ক্ষমতা ১৪ হাজার ঘনমিটার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের মতে, সিইটিপি আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে স্থাপন করা হয়নি।
এছাড়াও, প্ল্যান্টে কোনো ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট নেই এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা কোনো সুবিধা নেই।
কিন্তু ট্যানাররা বলছেন, সিইটিপি থেকে নিঃসৃত পানির মান ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে।
সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, গত জুলাই থেকে একটি কোম্পানি সিইপিটি পরিচালনা করছে এবং পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে।
"আগামী দুই মাসের মধ্যে এটি আরও উন্নত হবে," তিনি যোগ করেন।
বিসিক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান উল্লেখ করেন, সিইটিপিতে নিয়মিত রাসায়নিক ব্যবহার করায় এখন দূষণের মাত্রা অতিক্রম করার কোনো সম্ভাবনা নেই।