ঈদের আগে নিম্নমুখী খাতুনগঞ্জ মসলার বাজার
ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র ৮ দিন। পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এখন মসলাপণ্য ব্যবসার ভর মৌসুম। আসন্ন কোরবানির ঈদকে ঘিরে আমদানি ও সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে নিম্নমুখী চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জের মসলার বাজার।
এরমধ্যে কয়েকটি মসলার দাম কমে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। এই অবস্থা চলতে থাকলে লোকসান আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আসন্ন কোরবানির ইদকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি সব মসলার সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে ব্যবসায়ীরা। আশা ছিল অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও কোরবানিকে ঘিরে মসলার ভালো ব্যবসা হবে।
কিন্তু মসলার দাম বৃদ্ধি তো দূরের কথা। বিকিকিনি না হওয়ায় উল্টো বেশিরভাগ পণ্যের দাম কমেছে। এমনকি বাকি কয়েকটি দিনেও বিকিকিনি বাড়বে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা মসলাপণ্য (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি রসুনের দাম কমেছে কমপক্ষে ৪০-৬০ টাকা।
একই সময়ে আদার দাম কমেছে কেজিতে কমপক্ষে ২০ টাকা। বিকিকিনি কম থাকলেও কোরবানির ঈদকে ঘিরে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আদার অস্বাভাবিক দরপতন হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ জুন) খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে প্রতিকেজি চীনা রসুন বিক্রি হয়েছে ৮৮-৯০ টাকা দামে। যা দুই সপ্তাহ আগে ১৫০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। একইভাবে দুই দিন আগে চীনা আদার দাম ছিল ৬৫-৭০ টাকা। যা এখন ৪৭-৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
আমদানি বন্ধ থাকায় গত সপ্তাহেও পেঁয়াজের দাম ছিল উর্ধ্বমুখী। কোরবানির আগে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন (আইপি) দিতে পারে এমন খবরে গত দুই দিন ধরে কমতে শুরু করেছে পণ্যটির দাম। গত দু'দিন আগেও বাজারে পাইকারিতে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০-৬০ টাকার মধ্যে। দুই দিনের মধ্যে ১০ টাকা দাম কমে এখন মানভেদে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়।
আদা-রসুন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জারিফা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জুনায়েদুল হক বলেন, বর্তমানে যেসব রসুন কেজিপ্রতি ৮৭-৮৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে তা আমদানিতে ৯৫ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতিকেজি ৮ টাকা হিসেবে প্রতি কন্টেইনার রসুনে (২৯ হাজার কেজি) ২ লাখ ৩২ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।
একইভাবে ৬৫ টাকায় আমদানি হওয়া আদা বিক্রি করতে হচ্ছে ৪৭-৫০ টাকায়। যাতে কেজিতে ১৫ টাকা করে প্রতি কন্টেইনারে (২৭ হাজার কেজি) ৪ লাখ টাকার উপরে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা মসলা পণ্যের (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) পাইকারি মার্কেট হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস মিয়া বলেন, "কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে যেই বিকিকিনি হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। বন্যার কারণে বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা বাজারে আসছে না। ফলে যেসব পণ্যের বাড়তি সরবরাহ হয়েছে সেইসব পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে।"
তিনি জানান, কাঁচা এবং পচনশীল পণ্য হিসেবে গত দুই সপ্তাহে রসুন ও আদার দাম কমেছে অনেক বেশি। এভাবে চললে এবারে ব্যবসায়ীদের বড় অংকের লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরবরাহের চেয়ে বিকিকিনি কম হওয়ায় বেশিরভাগ শুকনা মসলা পণ্যের দামও নিম্মমুখী। গত দুই সপ্তাহ ধরে খাতুনগঞ্জে নিম্মমুখী রয়েছে মসলা পণ্য হলুদ, ধনিয়া, জিরা, এলাচ, দারচিনি, গোল মরিচ ও লবঙ্গের দাম।
এসব পণ্যের মধ্যে কেজিতে ১৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে আমদানিকৃত এলাচের দাম। বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১৫০ টাকা দামে। যা দুই সপ্তাহ আগে ১ হাজার ৩০০ টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে।
কেজিতে ১০০ টাকা কমে বর্তমানে প্রতিকেজি লবঙ্গ ৯৫০ টাকা, কেজিতে ৫০ টাকা কমে জিরা ৩৫০ টাকা, গোল মরিচ ৫০০ টাকা, কেজিতে ৩০ টাকা কমে ধনিয়া ৯০ টাকা, কেজিতে ৩০ টাকা কমে দারচিনি ২৮০ টাকা, মিষ্টি জিরা ১৬০ টাকা ও কেজিতে ২০ টাকা কমে প্রতিকেজি হলুদ ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার টন মসলা আমদানি হয়। যার আমদানি মূল্য ৬০০-৭০০ কোটি টাকা। মসলা পণ্যের মধ্যে ধনিয়া ছাড়া বাকি সব পণ্য কম-বেশি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী ও মেসার্স ইসহাক সওদাগরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সেকান্দার হোসেন বলেন, "কোরবানির ঈদকে ঘিরে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই সময়ে বাড়তি মসলা আমদানি করে এই খাতের ব্যবসায়ীরা। ফলে স্বাভাবিক সময়ে কোরবানির ইদের দুই-তিন সপ্তাহ আগে থেকে মসলা পণ্যের বিকিকিনি শুরু হয়।"
"কিন্তু দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার কারণে এবারে বাজারের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে মসলা পণ্যের বিকিকিনি খুবই কম। বিকিকিনি না থাকায় বাজারে বেশিরভাগ মসলা পণ্যের দাম নিম্মমুখী," যোগ করেন তিনি।
খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক অসীম সাহা বলেন, প্রতিবছরের মতো এবার বাজারে তেমন ক্রেতা নেই। ফলে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদামে স্তুপ হয়ে আছে মসলা পণ্য। এতে এবারে মসলা আমদানিকারকদের বড় লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ পাইকারি গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি অমর কান্তি দাশ বলেন, দেশের আমদানিকৃত মসলার ৭০ শতাংশ বিকিকিনি হয় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জকে ঘিরে।
আসন্ন কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে খাতুনগঞ্জের মসলার আড়ত ও দোকানগুলোতে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকার মসলা আমদানি শেষে মজুদ রয়েছে। কিন্তু মসলা বিক্রির বর্তমান যেই অবস্থা তা অব্যাহত থাকলে এবারে খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে শত কোটি টাকা লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আমদানি বৃদ্ধির কারণে উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় আমদানিকারকদের লোকসান হলেও খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে মসলা পণ্য। চট্টগ্রামের দুই নম্বর গেট এলাকার কর্ণফুলী মার্কেট ও কাজির দেউরি কাঁচাবাজারে ঘুরে দেখা গেছে, ১০০ গ্রাম এলাচ বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়।
একই পরিমাণ লবঙ্গের দাম ১২০ টাকা, দারচিনি ৫৫ টাকা, জয়ত্রী ৩০০ টাকা, জায়ফল ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে প্রতি ১০০ গ্রাম। এছাড়া খুচরা বাজারে আদার কেজি ১০০ টাকা, রসুনের কেজি ১২০ টাকা, পেয়াজের কেজি ৫৫ টাকা, ধনিয়া গুঁড়ার কেজি ২৪০ টাকা, গুঁড়া হলুদের কেজি ২৫০ টাকা, গুঁড়া মরিচের কেজি ৪৪০ টাকা, জিরার কেজি ৪৪০ টাকা, মিষ্টি জিরার কেজি ২৪০ টাকা।
কাজির দেউরি কাঁচাবাজারের মেসার্স ইলিয়াস স্টোরের স্বত্তাধিকারী মো. ইলিয়াস সওদাগর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা অল্প অল্প পণ্য এনে খুচরায় বিক্রি করি। মসলার বেচাবিক্রি কম। তাই আগের পণ্যই এখনো বিক্রি শেষ হয়নি।"