রাজস্ব আহরণ কমায় সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়েছে
বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কম হওয়ায় ঘাটতি বাজেট পূরণে সরকারের ব্যাংক ঋণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় দুইগুণ বেড়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নেয় ২৬,০৭৮ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে ব্যাংক ঋণ নিয়েছে ৬৪,৭৫৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে ব্যাংক ঋণ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৩৮,৬৭৭ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রভিশনাল তথ্য সূত্রে এটি জানা গেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সংশোধিত জাতীয় বাজেটে সরকারি অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছিল ১.২৪ লাখ কোটি টাকা; ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা পুনঃনির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৭,২৮৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকার লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৭৪.১৮ শতাংশ ঋণ নিয়েছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণ শ্লথ গতির ছিল, অর্থবছরের শেষ সময়ে অর্থাৎ জুন মাসে ব্যাংক ঋণ অনেক বেড়েছে। কারণ সরকারের রাজস্ব আহরণ ও সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ কম এসেছে। যার কারণ বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের বকেয়া অর্থ পরিশোধের জন্য ব্যাংক ঋণ বাড়িয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের মে পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করেছে প্রায় ২ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যা তাদের লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম। যার কারণে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় স্কিম বিক্রির মাধ্যমে ৩২,০০০ কোটি টাকা সহ মোট ৩৭,০০১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার।
এরমধ্যে সরকার ঘাটতি বাজেট মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে চলতি অর্থবছরের এগারো মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে মোট নীট ঋণ নিয়েছে ১৮,১৫৭ কোটি টাকা। যা সরকারের অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৬.৭৪%।
এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংকিং খাতের ঋণের পরিমাণ অনেকটা শ্লথ গতিতে থাকলেও অর্থবছরের শেষ মাসে ঋণের পরিমাণ অনেকটা বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ঋণের বিপরীতে সুদহার ফিক্সড থাকায় অধিক নিরাপত্তার কারণে সরকারের ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে মে পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২,৬৫২ কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪,৭৫৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকার এগারো মাসে যে ঋণ নিয়েছে একমাসেই সেই পরিমাণ ঋণ নিয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'সরকারকে অর্থবছরের শেষ সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন বাজেটের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে হয়, যার কারণে ঋণের পরিমাণটা বেড়েছে। এছাড়া রাজস্ব আহরণ অনেকটা কম ছিল।'
সঞ্চয়পত্র ঋণের তুলনায় ব্যাংক ঋণ সরকারের জন্য ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিদায়ী অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে যে ঋণ নিয়েছে নতুন অর্থবছরেও ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে।'
সরকারি ঋণে ভালো সুদ পাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ব্যাংক ঋণে নিদিষ্ট ক্যাপ দেয়া হয়েছে সেখানে বিনিয়োগ করলে খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তারচেয়ে সরকারি ট্রেজারি বিলে সুদ হারও বেশি এবং বিনিয়োগে নিরাপত্তা রয়েছে তাই ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিলে অধিক বিনিয়োগ করছে।'
২৭ জুন ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তোলার ট্রেজারি বিলের নির্ধারিত অ্যাকশন ডেট ছিল। এ দিনে ৯১-দিন এবং ৩৬৪-দিন ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে যথাক্রমে ৫,৭০৮ কোটি ও ৭৫৬ কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য ছিল। অথচ ব্যাংকগুলো এই দুটি বিলের বিপরীতে বিট দাখিল করেছে ১৩,৫২২ কোটি টাকা। ৯১-দিনের বিলের সুদ হার ছিল ৫.৯৯ টাকা ও ৩৬৪ দিনের বিলে ৬.৬৬ কোটি টাকা।
সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসে (জুলাই-মে) এডিপি বাস্তবায়ন করা হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৬৫.৫৬% এবং আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।
নতুন অর্থবছর ২০২২-২৩ এর জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।