বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে এক বাধা: আইএমএফ
ফরেক্স ক্রাইসিসের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে চলমান অস্থিরতা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলোতে মন্দা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় প্রধান বাধা বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
এছাড়া, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সেসব তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংকখাতের দূর্বলতা দূর করতে সংস্কারের সুপারিশসহ আমানত ও ঋণের সুদহারে বিদ্যমান ৬ শতাংশ ও ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা তুলে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে সংস্থাটির সফরকারী প্রতিনিধিদল।
আইএমএফের এশিয়া এন্ড প্যাসেফিক ডিপার্টমেন্টের প্রধান রুহুল আনন্দ-এর নেতৃত্বে সফররত আইএমএফ মিশন রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে পৃথক সভায় এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলে বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে।
অর্থবিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন অতিরিক্ত সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ন্ডকে বলেন, মিশনের কর্মকর্তাদের সামনে বাংলাদেশের ম্যাক্রো ইকোনমি স্ট্যাবিলিটির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছি। তাতে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মিশনের কর্মকর্তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আইএমএফকে জানিয়েছে যে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে ধরে রাখতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া সকল পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার সুফল ইতোমধ্যে পাওয়া শুরু হয়েছে।
'গত মে মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে ১৫ শতাংশে এ নেমেছে। ফলে গত অর্থবছরের ১১ মাসে যেখানে গড় আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ, মে মাস শেষে তা ৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে। জুন মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি আরও কমবে। ফলে গত অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩০ শতাংশে নেমে যাবে'- আইএমএফ মিশনকে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ।
মূল্যস্ফীতির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা সংকোচিত হচ্ছে এবং আমদানি ব্যয়ও কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আইএমএফ থেকে প্রস্তাবিত ৪.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সাপোর্ট পেলে রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং ইন্টারব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেটও স্থিতিশীল হবে বলে আইএমএফ মিশনকে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এটি বাড়াতে আইএমএফ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ইমার্জেন্সি বাজেট সাপোর্ট নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। 'এসএমইখাতের উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষায়' ব্যয় করতে এ পরিমাণ অর্থ ঋণ দিতে চলতি সপ্তাহেই আইএমএফের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেবে অর্থ বিভাগ।
এই ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসাবে ভর্তুকি প্রত্যাহারের কোনো সুপারিশ আইএমএফ করেছে কি-না, এমন প্রশ্নে অর্থ বিভাগের ওই অতিরিক্ত সচিব জানান, আইএমএফ মিশন ভর্তুকি প্রত্যাহারের বিষয়ে কোন সুপারিশ করেনি। এই সময়ে এ ধরনের সুপারিশ করার কথাও নয়। এমনিতেই মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে, ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
'আমাদের ম্যাক্রো ইকোনমি পরিস্থিতির সব দিকই তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে উচ্চ দরে জ্বালানি ও ফার্টিলাইজার আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ায় ফরেন এক্সচেঞ্জ রেটে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এটি স্থিতিশীল করার উপর জোর দিয়েছে সফরকারীরা'- জানান তিনি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এলএনজির ব্যবহার কমানো হয়েছে। কমদামের কয়লার উপর নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। আগামী একমাস আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সেপ্টেম্বরে লোডশেডিং রেশনিং বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এ সময় আইএমএফ কর্মকর্তারা জানান যে, রাশিয়া থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে পৃথক সভায় চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আইএমএফ। রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে মন্দা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমতে থাকলে সরকার কী পদক্ষেপ নেবে, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে মিশন।
জবাবে বাণিজ্য সচিব বলেছেন, ২০০৭-০৮ সালের দিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেনি। কারণ, বাংলাদেশ কম দামের পোশাক রপ্তানি করে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা কমলেও এ ধরনের পোশাকের চাহিদা কমে না।
'মন্দা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ রপ্তানি পণ্য ও রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে, ল্যাটিন আমেরিকাভুক্ত দেশ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগ নিচ্ছে। একই সঙ্গে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, লেদার এন্ড লেদার গুডস, এগ্রি প্রোডাক্টস রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে'- আইএমএফ মিশনকে জানিয়েছেন তপন কান্তি ঘোষ।
২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের রপ্তানির উপর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের করণীয় সম্পর্কেও জানতে চেয়েছে আইএমএফ। জবাবে বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়ার তথ্য তুলে ধরেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে পৃথক সভায় ইন্টারেস্ট রেটের ক্যাপ তুলে দেওয়া এবং সন্তোষজনক রিজার্ভ ধরে রাখার পাশাপাশি বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার উপরে আইএমএফ জোর দিয়েছে বলে জানা গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে, সে সম্পর্কে তথ্য নিয়েছে আইএমএফ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে মিটিং করেছেন আইএমএফ মিশন হেড রাহুল আনন্দ। এই মিটিংয়ে চারজন ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। এটাকে একপ্রকার সৌজন্য সাক্ষাৎ বলা যায়।
তিনি আরো বলেন, 'জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (বিওপি), ক্যাশ ফ্লো-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েই সভায় কথা হয়েছে। সেইসঙ্গে দেশের ম্যাক্রো ইকোনমিক্স এবং মনেটারি পলিসি নিয়েও তারা আলাপ করেছেন। এছাড়া সভায় আমাদের মনেটারি পলিসি, ফিনান্সিয়াল পলিসি, এক্সচেঞ্জ রেটের স্ট্যাবিলিটি নিয়ে মতবিনিময় হয়েছে।'
গভর্নর ছাড়াও আইএমএফ কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের মনেটারি পলিসি ডিপার্টমেন্ট, ফরেক্স রিজার্ভ এন্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও মিটিং করেছেন।