ফার্নেস অয়েলের মজুদ কমছে, লোডশেডিং আরও বাড়তে যাচ্ছে
দেশের এক-পঞ্চমাংশ বিদ্যুতের চাহিদা মেটায় ফার্নেস অয়েল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি। কিন্তু, তাদের মজুদ কমতে থাকায় লোডশেডিং পরিস্থিতি আরও বাজে রূপ নিতে চলেছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলি জানিয়েছে, স্পট মার্কেটে ব্যাপক চড়া মূল্যের কারণে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি সচল রাখতে অতি-দরকারি–এলএনজি কেনাও বন্ধ করেছে সরকার।
জাতীয় কোষাগারের ওপর চাপ কমাতে সরকার সম্প্রতি তিনটি সরকারিসহ ১১টি ডিজেল-চালিত বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করেছে। তবে এসব কেন্দ্র অলস বসিয়ে রাখলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বছরে তাদের ১,৭০০ কোটি টাকা দিতে হবে।
চুক্তি অনুসারে, ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিকে এই অর্থ পরিশোধে সরকারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও, তাতে করে অন্তত ১ লাখ ৪৩ হাজার টন ডিজেল আমদানির খরচ কমবে।
দেশে সবচেয়ে বেশি বা ৭২ শতাংশ ব্যবহৃত জ্বালানি হলো- ডিজেল, যার মজুদ এখন মাত্র ৪ লাখ টনে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সূত্রগুলির মতে, ডিজেলের দৈনিক চাহিদা প্রায় ১৬ হাজার টন। সে হিসাবে, দেশে এখন মাত্র ২৫ দিনের মজুদ আছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, বিপিসির কাছে সব ধরনের জ্বালানি তেলের অন্তত ৪৫ দিনের মজুদ থাকে।
এদিকে মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'বর্তমানে আমাদের কাছে ৩০ দিনের বেশি স্টক আছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমরা বছরের প্রথমার্ধে জ্বালানি আমদানি করেছি এবং চুক্তি অনুযায়ী, দ্বিতীয়ার্ধেও আমদানি করব'।
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি ডেলিভারির বিপরীতে অর্থ পরিশোধ গত দুই মাস বিলম্বিত হয়েছে।
সংকটময় এই পরিস্থিতিতে আশাবাদী হওয়ার কারণ হতে পারতো- ১,৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লা-ভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা আগামী সেপ্টেম্বরে কার্যক্রম শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু, এনিয়ে স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই–কারণ ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বিদ্যুতের অতি-চাহিদাসম্পন্ন অঞ্চলের পরিবর্তে রামপালে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শুধুমাত্র সরবরাহ করা যাবে দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে।
রামপালকে বিদ্যুতের প্রধান গ্রিডে আনতে হলে, সরকারকে পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে একটি সঞ্চালন লাইন স্থাপন করতে হবে। আগামী বছরের আগে যা সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সোমবার (১৮ জুলাই) সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ-ও আগামীতে আরো লোডশেডিংয়ের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
বন্ধ স্পট মার্কেটের এলএনজি কেনা
ফার্নেস অয়েল বা ডিজেলের চেয়ে সস্তা জ্বালানি হলো- প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু, মূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে সরকার আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ করেছে। ফলে গ্যাসের সার্বিক সরবরাহেও টান পড়েছে।
দেশের মোট গ্যাস ব্যবহারের মধ্যে, প্রায় ২৩ থেকে ২৪ শতাংশই আমদানি করা এলএনজি থেকে আসত– যার মধ্যে ৩ শতাংশ ছিল স্পট এলএনজি ক্রয় থেকে।
মহামারির পর তার অভিঘাত থেকে বিশ্ব অর্থনীতির উত্তরণের প্রতিযোগিতা এবং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে জ্বালানি সরবরাহের বিচ্ছিন্নতা–আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে এলএনজির মূল্যকে রেকর্ড উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রতি এমএমবিটিউ (মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) স্পট এলএনজির দর ৪১ ডলার, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল মাত্র ৩ ডলারের নিচে।
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমাতে সরকার স্পট এলএনজি আমদানি বন্ধ এবং লোডশেডিং করার মতো কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকট মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত সোমবার এসব পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়।
এসময় গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির বিষয়ে নসরুল হামিদ বলেন, 'স্পট মার্কেটে দাম না কমা পর্যন্ত আমরা সেখান থেকে এলএনজি আমদানি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি'।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের দ্বিতীয় বৃহৎ উৎসের প্রধান জ্বালানিও ফুরিয়ে আসছে:
গ্যাস-ভিত্তিক প্ল্যান্ট ছাড়া দেশের দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ফার্নেস অয়েল পোড়ানো কেন্দ্রগুলি। এ উৎসও সংকুচিত হচ্ছে।
ফার্নেস অয়েল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি ২১ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। শীতকালে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা কমে। কিন্তু তার আগেই দেখা দেওয়া ফার্নেস অয়েলের ঘাটতি, শীত আসার আগে আগামী তিন থেকে চার মাস আরও লোডশেডিংয়ের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। গত মার্চ থেকে তাদের বিদ্যুতের বিল পরিশোধ না করা হয়নি। ফলে তারা ডলার সংকটের এ সময়ে জ্বালানির পর্যাপ্ত মজুদও করতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ডলার সংকটের কারণে তারা নিয়মিত প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় ফার্নেস অয়েলের মজুদ ফুরিয়ে আসছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে, বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ইমরান করিম টিবিএসকে ফার্নেস অয়েলের মজুদ কমে আসার বিষয়টির সত্যতা রয়েছে বলে জানান।
তিনি বলেন, 'ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মজুদ নিয়ে বিপাকে পড়েছে, অন্যদিকে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকরাও একই সমস্যায় পড়বেন। এ পরিস্থিতিতে, জ্বালানি আমদানি ও মজুদ স্বাভাবিক রাখতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক অক্লান্ত পরিশ্রম করছে'।
বিপিসির সূত্র জানিয়েছে, ফার্নেস অয়েল ছাড়াও অন্যান্য ধরনের জ্বালানি আমদানিতে এলসি খোলার সমস্যার কারণে সেগুলির মজুদও হ্রাস পাচ্ছে। ডলারের বাজার দরের চেয়ে কম হওয়ায় ব্যাংকগুলি ঘোষিত দরে বিপিসির জন্য আমদানির এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। চলমান ডলার সংকটকালে সরকার নির্ধারিত হারে অন্য ব্যাংকগুলি যাতে বিপিসিকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সহায়তা করে এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তাও চাওয়া হয়েছে।
বৃষ্টি ও রামপাল স্বস্তির কারণ হতে পারে
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) আভাস অনুযায়ী, গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রার কারণে বেড়ে যাওয়া বিদ্যুৎ চাহিদা আগামী অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে।
ততদিন জ্বালানি সংকট আর লোডশেডিংয়ে ভুগতে হবে দেশবাসীকে।
তবে বৃষ্টিপাতে আবহাওয়া কিছুটা শীতল হলে এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল হলে- তা জ্বালানি ঘাটতিকে কিছুটা কমিয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।