বিদ্যুৎ সংকট: পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের লোকসানের আশংকা ট্যানারি মালিকদের
দেশব্যাপী চলমান এই বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে অন্যান্য শিল্প খাতের মতো আক্রান্ত হয়েছে দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী খাত চামড়া শিল্প।
ঈদুল আযহা পরবর্তী চামড়া শিল্পের চলমান এই মৌসুমে ক্রমাগত লোডশেডিংয়ের কারণে ইতিমধ্যে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর বেশ কিছু ট্যানারিতে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যায়ে অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কারখানায় চামড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে জানতে পেরেছি, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এবছর বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে ট্যানারি মালিকদের।'
অপরদিকে বিদ্যুৎ এর চলমান এই সংকট প্রসঙ্গে চামড়া শিল্প নগরী বিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান রিজোয়ান বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট পল্লী বিদ্যুৎ এর কর্মকর্তাদের সাথে সভা করেছি, যেহেত চামড়ার বিষয়টি ভিন্ন, এখানে লোডশেডিং হলে চামড়া নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে, তাই আমরা তাদের অনুরোধ করেছি কখন তারা লোডশেডিং দিবেন সেটি যেন আমাদের অন্তত ২৪ ঘন্টা আগে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে আমরা সেই হিসাবে প্রস্তুতি নিয়ে কার্যক্রম চলমান রাখতে পারবো, চামড়া নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকবে না। সবমিলিয়ে আমরা সার্বক্ষণিক বিষয়টি নজরদারি করছি।'
চামড়া নষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে টিবিএসকে তিনি বলেন, 'আমরা জেনেছি কিছু ট্যানারিতে চামড়া নষ্ট হয়েছে, তবে সেটি আমরা এখনো নিশ্চিত না কারা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্যানারিতে চামড়া নষ্ট হয়ে থাকলে তা কী পরিমাণ, এর বিস্তারিত জানতে আমরা ইতিমধ্যে ট্যানারি মালিকদের চিঠি দিয়েছি।'
চামড়া শিল্প নগরীর খোকন ট্যানারির মালিক মো. আকবর বলেন, 'দৈনিক ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে। একবার লোডশেডিং হলে ডাইং বা কালার প্রসেসিং পর্যায়ে অন্তত ১ থেকে ২ হাজার চামড়া নষ্ট হয়ে যায়, ২ হাজার চামড়া নষ্ট মানে এর পরিমাণ অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ হাজার স্কয়ার ফুট।'
'কাঁচা চামড়া আমরা যখন প্রক্রিয়াজাত শুরু করি, তখন এটির কাজ বন্ধ রাখার কোন উপায় থাকে না। এসময় কোন কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গেলে, বিশেষ করে ডাইং ও কালার প্রসেসিং পর্যায়ে এটি হলে চামড়ায় স্পট পড়ে যায়। যার কারণে সেই চামড়ার দাম কমে যায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত, এটি সম্পূর্ণ লোকসান আমাদের। এই মৌসুমে প্রায় ১ লাখেরও অধিক চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য রয়েছে আমাদের। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার পিস কাঁচা চামড়া আমরা সংগ্রহ করেছি, আরও ৫০ হাজার চামড়া লাইনে আছে। তো এভাবে চলতে থাকলে তো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে আমাদের', বলেন তিনি।
ঢাকা হাইড এন্ড স্কিনস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রশিদ ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, 'একদিকে লোডশেডিং, অন্যদিকে পানি সংকট। এসব কারণে একদিন 'র' এবং ওয়েট ব্লু সেকশনে কাজ চললেও অন্য সেকশনে প্রায় ৩০০ শ্রমিক বসা ছিলো। একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, পাশাপাশি বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। সব কাজ তো জেনারেটর দিয়ে সম্ভব না। তাছাড়া এখন পর্যন্ত আমাদের অন্তত ৫ হাজার পিস গরুর চামড়া ও ১০ হাজার পিস ছাগলের চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে, যার ক্ষতির পরিমাণ অন্তত ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা।'
পানি সরবরাহ সংকট প্রসঙ্গে ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানী লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী এস এন পাল টিবিএসকে বলেন, 'একটি সার্কিট ব্রেকারে ত্রুটির কারণে সবমিলিয়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মত পানি সরবরাহ লাইনে সমস্যা হয়েছিলো, তবে সেটি গতকালই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, আপাতত আর কোন সমস্যা নেই।'
জানতে চাইলে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ট্যানারি জোন অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. গোলাম কাদির টিবিএসকে বলেন, 'আমার জোনে দৈনিক বিদ্যুতের মোট চাহিদা ৪০ মেগাওয়াট, যার বিপরীতে আমার এখানে সরবরাহ রয়েছে এই মুহুর্তে ২২ মেগাওয়াট মাত্র। এর মধ্যে ট্যানারিরই চাহিদা রয়েছে ১২ মেগাওয়াট। অপরদিকে ট্যানারি ব্যতিত এই জোনে গার্মেন্টস সহ বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা রয়েছে অন্তত ৩০ থেকে ৪০টি, সেদিকেও আমাদের নজর রাখতে হচ্ছে। তারপরেও যেহেতু চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটি বিষয় রয়েছে, আমরা চেষ্টা করছি মোট ২৩টি ফিডারের মধ্যে ট্যানারিতে যে ১০টি রয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে বাকি ১৩টি ফিডারে রেশনিং এর মাধ্যমে লোডশেডিং করতে।'
সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর অন্তত ৫ থেকে ৭টি ট্যানারি কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, যাদের অধিকাংশই জানিয়েছেন দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের কারণে বেশ বিপাকে রয়েছেন তারা।
আজমির লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল্লাহ জানান, জেনারেটর থাকায় চামড়া নষ্ট না হলেও লোডশেডিংয়ের কারণে অন্তত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে তাদের, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন কার্যক্রম।
একই রকম কথা বলেন পূবালী ট্যানারির মালিক মাহবুবুর রহমান পান্না ও এসবি শাহী ট্যানারির মালিক মো. শাহজাহান।
চামড়া শিল্প নগরী সূত্র বলছে, বড় ট্যানারি কারখানাগুলোর জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও ছোট ট্যানারিগুলোতে জেনারেটর না থাকায় বেশি বিপাকে রয়েছেন তারা।
চলমান এই পরিস্থিতে দেশের চামড়া শিল্পকে রক্ষা করতে সরকারের প্রতি অন্তত আগামী ৩ মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে আমাদের। করোনার কারণে এমনিতেই আমরা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি, যা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছি গত বছর।
গত বছর আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ছিলো ১.২৫ বিলিয়ন ডলার যেখানে এ বছর আমরা ১.৫০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছি। কিন্তু এভাবে লোডশেডিং অব্যাহত থাকলে এই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তো হবেই না উপরন্তু বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়তে হবে আমাদের। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি অন্তত এই মৌসুমে আগামী ৩ মাস আমাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করা হোক।'