স্বর্ণে নয়, আসল ম্যাজিক ডলারে
মুদ্রার মান যখন কমে, সে তুলনায় বাড়ে পণ্য ও সেবার দাম—তখনই দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কালেও মান কমে মুদ্রার। তখন নিরাপদ বিনিয়োগ উৎস হিসেবে কদর বাড়ে স্বর্ণের। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ব অর্থনীতি ঘোর অনিশ্চয়তাতেই পড়েছে। সে অনুযায়ী, স্বর্ণের দিকেও ঝোঁকার কথা ছিল—অর্থের মূল্য ধরে রাখতে উৎসুক বিনিয়োগকারীদের । অথচ, আদর্শ পরিস্থিতি থাকার পরও চলতি বছর স্বর্ণের দর কমেছে। মূল্যবান ধাতুটি পুঁজি আকর্ষণে তার প্রতিযোগী ডলারের চেয়ে দুর্বল পারদর্শীতাই দেখাচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে চলছে এখন রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, করা হচ্ছে মন্দার শঙ্কা। তাতে স্বর্ণের বাজার চাঙ্গা হওয়ারই কথা। গত মার্চের শুরুতে প্রতি আউন্সের দর ২,০০০ ডলার ছাড়ায়, কিন্তু তারপর থেকেই এর বাজারদর ১৫ শতাংশ কমেছে। এপর্যন্ত যা বার্ষিক হিসাবে ৫ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, মার্চের শুরু থেকে ডলারের মূল্য সূচক বেড়েছে ৯ শতাংশ। চলতি বছর যে দরে শুরু করেছিল, তার চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি শক্তিশালী এখন আমেরিকার মুদ্রা।
গেল সপ্তাহে ডলার কিছুটা মূল্য হারালেও স্বর্ণ সেই সুযোগটা নিতে পারেনি বলে জানান আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময়কারী সংস্থা ওনাডার জ্যেষ্ঠ বাজার বিশ্লেষক জেফ্রি হ্যালি।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে এক নোটে তিনি লিখেছেন, 'যদি বলি স্বর্ণের দাম সম্ভাবনার তুলনায় বাজে পারফর্ম করছে, তাহলেও কমই বলা হয়। বাজারের টেকনিক্যাল তথ্যে আস্থা রাখলে বলা যায়, ধাতুটির দরে আরো ধস নামার ঝুঁকিও রয়েছে'।
অথচ দুনিয়ার সেরা অর্থনীতি আমেরিকা—যেখানে বেশিরভাগ সেরা ধনী ও বিনিয়োগকারীও থাকেন—রয়েছে ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে। স্বর্ণের চাকচিক্য ছড়ানোর জন্য ২০২২ সাল ছিল সুবর্ণ-সুযোগ। ওয়ালস্ট্রিটের পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও আর্থিক সংস্থাগুলো চলতি বছরেই বা আগামী বছর মার্কিন ভূখণ্ডে মন্দা আঘাত হানার পূর্বাভাসও দিচ্ছে। এই বাস্তবতায় নিরাপদ বিনিয়োগ উৎস হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা আকাশ ছোঁয়ারই কথা। অথচ গেল বৃহস্পতিবার ১৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন বা ১,৬৮০ ডলারে নেমে আসে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দর।
একইসময়, ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দর অর্জন করেছে ডলার। নীতিনির্ধারণী সুদহার উচ্চ হারে বাড়িয়ে যার পেছনে মূল অবদান রাখে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ফেডারেল রিজার্ভ। গত মার্চের পর থেকে পর্যায়ক্রমে ২৫, ৫০ ও ৭৫ বেসিস পয়েন্টের মতো খাড়াভাবে সুদহার বাড়ানো হয়। আগামী বুধবার ফের বৈঠকে বসছে ফেড, সভাশেষে আরো ৭৫ বা ১০০ পয়েন্ট সুদহার বৃদ্ধির অনুমান করছেন বিশ্লেষকরা।
ফেডের এই উচ্চ সুদহারই আসলে স্বর্ণের দুরবস্থার জন্য দায়ী। কারণ, স্বর্ণে বিনিয়োগ করলে তার ওপর সুদ বা লভ্যাংশ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, চলতি আয়ের দিক থেকে ডলারের চেয়ে স্বর্ণ পরস্পর তুলনামূলক সম্পর্কে এক নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। এমন মন্তব্য করেছেন ইউবিএস এর বিশ্লেষক জিওভান্নি স্ট্যানোভো।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে ডলার ও স্বর্ণের মতো বিনিয়োগের 'নিরাপদ স্বর্গ' বলে পরিচিত সম্পদের চাহিদায় বড় উল্লম্ফন দেখা দেয়। তখন ডলার ও স্বর্ণের পরস্পর সম্পর্ক ইতিবাচকে রূপ নেয়। অর্থাৎ, স্বর্ণের দামই বেশি হয়। যেমনটা ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটকালে দেখা গিয়েছিল।
এদিকে স্বর্ণ একটি পণ্য। আর বিশ্ববাজারে অধিকাংশ পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ডলারের আধিপত্যও স্বর্ণের মূল্য আরো বৃদ্ধির পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে। ডলারের মান শক্তিশালী থাকলে তা স্বর্ণের মূল্যে নিম্নমুখী বা দাম কমানোর চাপ ফেলে।
এসব প্রবণতা চলমান থাকায়, স্বর্ণের ভবিষ্যৎ 'নিস্প্রভ' দেখাচ্ছে বলেই মন্তব্য করেন জিওভান্নি স্ট্যানোভো।
- সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার