সামষ্টিক অর্থনীতি কমফোর্ট জোনের বাইরে: সিপিডি
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পতন, বাণিজ্য ঘাটতি, টাকার মানের পতন এবং চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি 'কমফোর্ট জোনে'র বাইরে চলে গেছে বলে মনে করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
শনিবার 'রিসেন্ট চ্যালেঞ্জেস ফেসিং দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি: আ ব্রিফ ওভারভিউ' শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে রোববার এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
সিপিডির পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, কোভিড থেকে উত্তরণ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্টি হওয়া এই সংকট মোকাবিলায় যথাযথ উদ্যোগ না নেয়া হলে এই অস্বস্তি অচিরেই আতঙ্কে পরিণত হতে পারে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে আসছে।
১৯৭০-এর দশকের পর এ ধরনের স্ট্যাগফ্লেশন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশও এমন ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যখন বেকারত্ব চরমে ওঠে এবং চাহিদা স্থবির হয়ে পড়ে, সেই পরিস্থিতিকে স্ট্যাগফ্লেশন বলা হয়।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারি তথ্যে জুন মাসে ৭.৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে বলে দাবি করা হলেও বাজারে কিছু পণ্যের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
'মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজন থাকলেও ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এ ধরনের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ নীতিনির্ধারণী সুদহার বাড়ালেও বাজারে অনেক ডিসটরশন রয়েছে। তাছাড়া নীতি সুদহার বাড়লেও সুদের হারে ক্যাপের কারণে কোনো সুফল আসবে না,' বলেন তিনি।
মূল্যস্ফীতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দাবি করে ফাহমিদা খাতুন তাদের জন্য সহায়তা বৃদ্ধির দাবি জানান। কোভিড-পরবর্তী সময়ে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি এমন শিল্প খাতে সহায়তা অব্যাহত রাখারও তাগিদ দেন তিনি। তবে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ঢালাও সহায়তা না দিয়ে টার্গেটভিত্তিক সহায়তা দিতে হবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
কৃচ্ছ্রতা সাধনে সরকারের নেয়া উদ্যোগগুলোকে সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বিলাস দ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্পের ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপের সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। এসব উদ্যোগগুলোর যথাযথভাবে বাস্তবায়নের আহ্বানও জানান তিনি।
অনুসন্ধানে বিনিয়োগ না করে আমদানিনির্ভরতার কারণে জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে দাবি করে ফাহমিদা খাতুন গ্যাস অনুসন্ধানে দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান সরকারের প্রতি।
এছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানো, পুঁজি পাচার রোধ ও বৈশ্বিক ঋণদাতাদের পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক ঋণের অনুসন্ধানে গতি আনারও সুপারিশ করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কোভিডের প্রভাব থেকে অর্থনীতির কিছু অংশের পুনরুদ্ধার হলেও দরিদ্র মানুষের গড় আয় এখনও কোভিডপূর্ব সময়ের চেয়ে কম।
মূল্যস্ফীতির কারণে জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে প্রায় ২১ লাখ মানুষ দারিদ্র্য বরণ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে এই সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, আবাসনসহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর অর্জনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বাড়ছে। চাকুরির বাজার থেকে শুরু করে জনমিতিক লভ্যাংশ পর্যন্ত এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এই সংকট মধ্য মেয়াদে সংকট সৃষ্টি করার পাশাপাশি অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট করেছে মন্তব্য করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি সমস্যাগুলোর সমাধানে কার্য্যকর উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন হোসেন জিল্লুর রহমান।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপষ্টো ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কর্মসংস্থান নিশ্চিতের লক্ষ্যে মানুষের আয় ধরে রাখতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, 'দারিদ্র্যের সরকারি তথ্য সর্বশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকের ধারণা, ২০১৯ সালের ২০ শতাংশ থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৩০ শতাংশে উঠেছে। এই সমস্যাটার একটা স্বীকৃতি দেয়া দরকার।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে সমস্যা অনেক, এবং সবগুলোই চিহ্নিত। দুর্নীতি, অপচয়, অর্থ পাচারের মতো সমস্যাগুলো আগেই ছিল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈশ্বিক সমস্যা।
তিনি বলেন, 'ব্যাংকিং খাত অর্থনীতির নার্ভের মতো। এখানেই যদি দুর্বলতা থাকে, দুর্নীতি থাকে, অব্যবস্থাপনা থাকে, নন-কমপ্লায়েন্স অভ নর্মস থাকে, তাহলে অর্থনীতি কীভাবে এগিয়ে যাবে?'
সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত কয়েক বছর ধরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রতিযোগিতা কমে এলেও ডলার বিক্রি করে কৃত্রিমভাবে টাকার মান ধরে রাখা হয়েছে। 'এরই মধ্যে রিজার্ভের পরিমাণ কমে আসায় এক সাথে ১০ শতাংশ ডেপ্রিসিয়েশনের চাপ নিতে হচ্ছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে মুদ্রার বিনিময় হারে পতনের কারণে আমাদনি ব্যয় বাড়ছে ৩৩ শতাংশ। সঠিক বিবেচনার মাধ্যমে যথাসময়ে ধীরে ধীরে টাকার মানের অবনমন ঘটালে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।'
গত ১০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে দাবি করে মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'এই পাচার রোধে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। উল্টো চলতি বাজেটে পাচার হওয়া অর্থের বৈধতা দেয়ার অযৌক্তিক সুযোগ চালু করা হয়েছে।'
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণের বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, 'আইএমএফ যে সংস্কারের কথা বলছে সেগুলো মেনে নিতে হবে আমাদের স্বার্থেই।'
ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, রপ্তানির ভারসাম্য ঠিক রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ম তামিম বলেন, জ্বালানি অনুসন্ধান বাড়ানোর বদলে প্রাথমিক জ্বালানির জন্য অত্যধিক আমদানিনির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
'স্বনির্ভরতার জন্য আমাদের গ্যাস ও কয়লা দরকার ছিল। কিন্তু পরিবেশ ইস্যু ও বিদেশি বিনিয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে আমরা প্রাথমিক জ্বালানির উৎস দুটি অনুসন্ধান করতে পারিনি,' তিনি বলেন।