পাইকারিতে দুই দিনে গমের দাম কমেছে মণে ১০০ টাকা
খাদ্যশস্য রপ্তানিতে কৃঞ্চসাগর ব্যবহারে রাশিয়া-ইউক্রেনের চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমতে শুরু করেছে। সেই সাথে দেশীয় বাজারেও পণ্যটির দাম কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে। গত দুই দিনের ব্যবধানে পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ গমের দাম ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে বর্তমানে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ভারতীয় গম বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ টাকা দামে। যা গত সপ্তাহে ১৫০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই দিনেই পণ্যটির দাম মণে ১০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
ভারতীয় গমের পাশাপাশি মণে ৮০ টাকা পর্যন্ত কমেছে কানাডা থেকে আমদানিকৃত গমের দামও। গত সপ্তাহের শেষ দিকে বাজারে প্রতিমণ কানাডার গম বিক্রি হয়েছে ২০০০ টাকা দামে। যা আজকের বাজারে ১৯৩০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
এর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় গম ১৬৫০ এবং কানাডার গম ২১৫০ টাকায় ঠেকেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আগে (ফেব্রুয়ারি) প্রতি মণ ভারতীয় গম মাত্র ৯০০ টাকা এবং কানাডার গম ১১০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতো।
পাইকারি গম ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয় মাস আগেও দেশে প্রতি মণ গমের দাম ছিল মানভেদে ৯০০-১০০০ টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হলে গমের দাম বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ অর্থাৎ মণপ্রতি ২ হাজার ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এতে দেশে আটা ও গমের দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। খাদ্যশস্য হিসেবে চালের পর দেশে গমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকায় পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি দেশীয় বাজারেও গমের দাম কমতে থাকায় শিগগিরই আটা ও ময়দার দাম কমে আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
খাতুনগঞ্জের গম ব্যবসায়ী মেসার্স আমান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. আমান উল্লাহ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গমের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেনের চুক্তি, আন্তর্জাতিক বুকিং কমতে থাকায় দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। সর্বশেষ গত দুই দিনের ব্যবধানে পণ্যটির দাম মণপ্রতি অন্তত ৮০-১০০ টাকা কমেছে। ইউরোপের গমের সরবরাহ বিশ্বব্যাপী স্বাভাবিক হয়ে এলে দাম আরো কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
আমদানিকারকরা বলছেন, খাদ্যশস্য রপ্তানিতে সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তি করায় এখন কম দামে গমসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য আমদানি করা যাবে। চুক্তির ফলে বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নিম্নমুখী হওয়ায় বাংলাদেশ রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানি না করলেও এর সুফল পাবে। তাছাড়া সরাসরি আমদানি না করলেও তৃতীয় কোনো দেশ বা ওইসব দেশের এজেন্সির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করতে পারবে। বর্তমানে মধ্য ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে গমের উত্তোলন মৌসুম শুরু হয়েছে। আগামী কয়েক মাসে কানাডা, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী দেশের উত্তোলন মৌসুম শুরু হবে। যার কারণে আসন্ন মৌসুমটি বৈশ্বিক খাদ্যশস্যের বাজার নিম্নগামী অবস্থায় স্থিতিশীল থাকবে। এতে শীর্ষ ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে পণ্যবাজার আরো নিম্নমুখী হবে বলে আশা করছেন তারা।
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এ জামান এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী নুরুল আলম বলেন, ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে খাদ্যশস্যের বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ও রাশিয়ার বড় অংশগ্রহণ থাকায় দুনিয়াজুড়ে সংকট তৈরি করেছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের বেশকিছু ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। দেশীয় বাজারে ডলারের উচ্চমূল্য, পরিবহন খরচ বেশি থাকায় এর শতভাগ সুবিধা বাংলাদেশ না পেলেও ধীরে হলেও দেশের পণ্যবাজারের দামের ঊর্ধ্বমুখিতা নিম্নমুখী হবে বলে মনে করছেন তিনি।
তিনি আরো জানান, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার মানে হলো ইউক্রেন থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ইউক্রেনের প্রধান বন্দর রাশিয়ার দখলে থাকায় ইউরোপের বড় শস্যক্ষেত্রটি গোটা বিশ্বের কাছ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে বিকল্প বেশকিছু দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গমের বৈশ্বিক বাজার সাম্প্রতিক সময়ে ১০ শতাংশ কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ডলার মূল্যহার ১৮-২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমার প্রভাব পড়ছে কম। এক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কমলে সার্বিকভাবে সংকট কমে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে দেশে ৪০ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। অথচ এর আগের অর্থবছরে (২০২০-২১ সাল) দেশে গম আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪ দশমিক ৪৩ লাখ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গম আমদানি হয়েছিল ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৬ লাখ ২৯ হাজার টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টন গম।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পরদিনই আন্তর্জাতিক বাজার অস্থির হয়ে উঠে গমের বাজার। ইনভেস্টিং ডট কমের তথ্যমতে, যুদ্ধ শুরুর দিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গম বিক্রি হয়েছে ৯১৬ ডলারে। একদিন পর টানা বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র দুই সপ্তাহেই ৭ মার্চ পণ্যটির বাজার ঠেকে ১৪২১ ডলার। তবে আস্তে আস্তে কমে আজ রবিবার বিশ্ববাজারে প্রতি টন গম বিক্রি হয়েছে মাত্র ৭৫৫ ডলারে। অর্থাৎ যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে গমের দাম। সেই হিসেবে, তিন মাসে পণ্যটির দাম ৬৬৬ ডলার কমেছে।