লোডশেডিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খুলনার রপ্তানিমুখী মৎস্য খাত
খুলনাঞ্চলে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে সেখানকার রপ্তানিমুখী মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোতে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফএফইএ)।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুলনার অধিকাংশ এলাকায় নির্ধারিত চার-পাঁচ ঘণ্টার জায়গায় শিডিউল না মেনে কয়েক ঘণ্টা অতিরিক্ত লোডশেডিং হচ্ছে।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীনে যেসব কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে, সেগুলো দিনে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। যেখানে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অধীনে থাকা কারখানাগুলো দিনে ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হচ্ছে।
বিএফএফইএ'র সহ সভাপতি এস হুমায়ুন কবীর বলেন, 'বাংলাদেশে মোট ১০৫টি হিমায়িত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ করা হয় খুলনার বিভিন্ন কারখানায়।'
২০২০-২১ অর্থ বছরে বৈদেশিক বাজারে প্রায় ৭৬ হাজার ৫৯১ মেট্রিক টন বাংলাদেশি হিমায়িত সাদা মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়াসহ অন্যন্য পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা থেকে প্রায় ৪৭৭.৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়।
এরমধ্যে শুধুমাত্র হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল ৩০ হাজার ৬১৫ মেট্রিক টন। যা থেকে প্রায় ৩২৮.৮৪ মিলিয়ন ডলার আয় হয়।
এস হুমায়ুন কবীর বলেন, 'আমাদের রপ্তানিযোগ্য কাঁচামাল হল চিংড়ি ও মাছ। এটা সারাক্ষণ শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে রেখে সংরক্ষণ করতে হয়। কোনো কারণে যদি এই তাপমাত্রার উপরে উঠে যায়, তবে ওই মাছে ব্যকটেরিয়া জমতে শুরু করে। তখন তার গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়, বিদেশে আর রপ্তানি করা যায় না।'
তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আমাদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে হবে। সেই হিসাবে আমরা ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাবো না। কিন্তু আমাদের কারখানাগুলোতে ১০-১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না।'
সংকটে মাছ সংরক্ষণের বরফ
এই সীমিত সময়ের বিদ্যুৎ দিয়ে বরফ সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানালেন হুমায়ুন কবীর।
'১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা ব্যয় করে যে বরফ তৈরী করছি, ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলে তা পানিতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।'
বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বরফ কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বরফ কারখানায় গিয়ে চাহিদা অনুযায়ী বরফ পাচ্ছে না, মৎস্য চাষী ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা।
যারা প্রত্যন্ত এলাকার চিংড়ি চাষী ও সরবরাহকারী, তারা বরফ কিনতে পারছেন না উল্লেখ করে হুমায়ুন কবীর জানান, বরফ কলগুলো এখন ১০০ টাকার বরফ এক হাজার টাকায় বিক্রি করছে।
এস হুমায়ুন কবীর আরও বলেন, 'হিমায়িত চিংড়ি মাছ শতকরা ১০০ ভাগই রপ্তানি পণ্য। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য এ শিল্পের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ জরুরী।'
বাগেরহাটের বারাকপুর মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম জানান, বিদ্যুতের সমস্যার কারণে বরফ কম জমাট বাধায় আগের থেকে বেশি টাকার বরফ দিয়ে মাছ পাঠাতে হচ্ছে। আগে যেখানে ১৫০০ টাকার বরফ দিয়ে এক পেটি মাছ ঢাকায় পাঠানো যেত এখন সেখানে প্রায় ২৪০০ টাকার বরফ প্রয়োজন হচ্ছে।
সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া ফিশিং ট্রলারের চালক মিকাইল ইসলাম বলেন, 'টানা ৬৫ দিন অবরোধ আমরা ঠিকমত মেনেছি। এখন আমরা সাগরে মাছ ধরতে যাবো। কিন্তু চাহিদানুযায়ী বরফ পাওয়া যাচ্ছে না।'
তিনি বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের অজুহাতে ভিতরে ফাঁকা বরফ দেয়া হচ্ছে, মাঝেমধ্যে কম জমাটবাধা বরফও দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
সুন্দরবন বরফ কলের ক্রেন অপারেটর মিঠুন মণ্ডল বলেন, 'দিন-রাতে অনেকবার বিদ্যুৎ যাওয়া-আসা করে। একবার বিদ্যুৎ গেলে অনেক সময় পরে আবার আসে। এ অবস্থায় বরফ ঠিকমত জমাতে পারছি না, একবার জমার পর আবার বিদ্যুৎ চলে গেলে সে বরফ গলে যায়।'
নাগের বাজারের বরফকল মালিক তারাপদ দাম বলেন, যেভাবে বিদ্যুৎ যাচ্ছে তাতে এখনই ক্রেতাদের ঠিকমত বরফ দিতে পারছেন না। আগামী দিনে বরফের চাহিদা পুরণ করা তাদের পক্ষে মোটেও সম্ভব হবে না। তাছাড়া বিদ্যুৎ যাওয়া আসার কারণে বৈদ্যুতিক মোটরসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের ক্ষতি হচ্ছে।'
বাগেরহাট চিংড়ি চাষী সমিতির সভাপতি ফকির মোহিতুল ইসলাম সুমন বলেন, 'লোডশেডিং এর কারণে বরফের সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে ঠিকমত মাছ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া রপ্তানির জন্য চিংড়ি হিমায়িত করতেও সমস্যা হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মাছ চাষীরা।'
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ.এস.এম রাসেল বলেন, 'বাগেরহাট একটি মৎস্যপ্রধান এলাকা। মাছ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিদ্যুতের প্রয়োজন। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে বরফ জমাতে পারছে না মিল মালিকরা। এতে সাগরে যাওয়ার জন্য জেলে ও ব্যবসায়ীরা বরফ পাচ্ছে না। আর হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজও করতে পারছে না।'
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজহারুল ইসলাম বলেন, 'এখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটা সুদুরপ্রসারী। সবাইকে এখন মিতব্যয়ী হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।'