জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় যেভাবে মানুষের টুঁটি চেপে ধরেছে
নিত্যপণ্যের দাম আগে থেকেই চড়া ছিল, জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক সময়ের রেকর্ড দাম বৃদ্ধিতে যা আরও বেড়েছে; ফলে প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো।
নিম্ন-আয়ের মানুষের আমিষ চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রধান উৎস হলো- ডিম। গত ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর থেকে যেসব পণ্যের মূল্য সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, তার মধ্যে এটিও রয়েছে।
বেড়েছে বাস ভাড়া; যা প্রতিনিয়ত কর্মস্থলে চলাচল করতে হয় এমন মানুষের ওপর বড় আঘাত হয়ে এসেছে।
নির্দিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলি মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া কমাচ্ছে। বাজেটের মধ্যে থাকতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পেছনেও কম খরচের পরিকল্পনা করছে তারা।
জীবনযাপনের ক্রমে বেড়ে চলা ব্যয়ের তুলনায় আয় হয়ে পড়েছে সামান্য; এতে আগামীতে শিল্পখাতে শ্রমিক সংকটের অনুমান করছেন শিল্পখাত সংশ্লিষ্টরা।
রাইড শেয়ারিং সেবাদাতারাসহ নিজস্ব কার ও মোটরসাইকেল ব্যবহার করছে এমন মধ্য আয়ের পরিবারগুলির জ্বালানি খরচ অনেকটাই বেড়েছে।
বাজার তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে জ্বালানি তেলের ৭৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধি এবং চরম ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে– গত আট মাসে নিত্যপণ্যের দাম অন্তত ৪০ শতাংশ বেড়েছে।
চাল, ডাল, ভোজ্যতেলের মতো রান্নাবান্নায় আবশ্যক পণ্যের পাশাপাশি সাবান, টুথপেস্ট, প্রসাধনী ও টিস্যু পেপারের মতো নানাবিধ গৃহস্থালী পণ্য হয়ে উঠেছে আরও দামি।
দুই দফায় জ্বালানির দাম বাড়ানোর পর পরিবহন খরচ বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।
করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর না বাড়ালেও, এ বছর বাড়ির মালিকেরা বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের বেতন ও খাতা-কলমের মতো স্টেশনারি পণ্যের দামও বেড়েছে।
নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ার তাৎক্ষণিক ভুক্তভোগী হলেও, মধ্য আয়ের মানুষও সেই জ্বালা অনুভব করছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)- এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম আয়ের তুলনায় বেড়ে গেলে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ প্রথমেই শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো ব্যয় সংকুচিত করেন।
তারা মাংস, ফল ও দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়া বন্ধ করে দেন এবং ভাত ও আলুর মতো শর্করা-সমৃদ্ধ খাবারের দিকে ঝোঁকেন। এতে দীর্ঘমেয়াদে দেশে পুষ্টিহীন প্রজন্ম তৈরির ঝুঁকি বাড়ে। এতে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও কমে যাবে বলে উল্লেখ করেন সেলিম রায়হান।
দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বমুখীতা ঠেকাতে– বাজার মনিটরিং জোরদার করার পাশাপাশি খাদ্যে ভর্তুকি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
দাম কতোটা বেড়েছে?
এই বছরের ৫ আগস্ট দাম বাড়ানোর আগে ২০২১ সালের ৪ নভেম্বরে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়ায়।
সরকারি সংস্থা- ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওই দিনের বাজারদরের তালিকা ও গত রোববারের তালিকা ধরে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোটা চালের দাম ১৪%, মসুর ডাল ২৩%, খোলা সয়াবিন ১৯%, ডিম ৪৫%, ব্রয়লার মুরগি ১৮%, আটা এক প্যাকেট ৩৮%, চিনি ১৩%, শুকনা মরিচ ৭৫%, আলু ২০%, হলুদ ১৩% এবং দেশী আদার দাম ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
টিসিবির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৫ আগস্ট তেলের দাম বৃদ্ধির পর গত দুই সপ্তাহের মধ্যে ডিম ৩১%, ব্রয়লার মুরগি ২৯%, পেয়াজ ২৫%, আটা ১০%, চিনি ১০%, শুকনা মরিচ ৯% ও মোটা চালের দাম ৪ শতাংশ বেড়েছে।
তবে বাজারে এসব পণ্যের প্রকৃত দাম টিসিবির দেওয়া হিসাবের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন ঢাকার প্রায় সব বাজারের ব্যবসায়ীরা।
এক বছর আগেও ৫০০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গরুর মাংস। কিন্তু, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর– সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে গরুর মাংস-সহ বেশ কিছু পণ্য। গতকাল স্বপ্ন সুপারশপে এক কেজি গরুর গোশত বিক্রি হয়েছে ৭৩০ টাকায়।
বলতে গেলে, মাছ, মাংস আর সবজিসহ সব নিত্যপণ্যই এখন ভোক্তাকে চড়ামূল্যে কিনতে হচ্ছে।
ঢাকার মগবাজারের সুমাইয়া স্টোরের হাসান আলী বলেন, 'কয়েকমাস আগেও একটি কাপড়কাচা সাবানের দাম ছিল ১৮ টাকা। এখন দাম ২৮ টাকা। মাঝারি আকারের সুগন্ধি সাবানের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। ৪৫ টাকায় আধা কেজি গুঁড়া সাবান পাওয়া যেত। এখন তা ৫২ টাকা'।
তিনি আরও বলেন, 'টুথপেস্টের মাঝারি প্যাকের দাম ৮-১০ টাকা বেড়ে ৫০-৫২ টাকা হয়েছে। শ্যাম্পুর ২ টাকার মিনিপ্যাক ৫ টাকা এবং ৫ টাকার মিনিপ্যাক এখন ৮ টাকায় উন্নীত হয়েছে। ৫-১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে ছোট ছোট প্যাকের চানাচুর, বিস্কুট, পাউরুটি, চিপসের মতো প্রক্রিয়াজাত খাবারের দাম'।
শিক্ষা উপকরণের দাম কতটা বেড়েছে, তা তুলে ধরে ঢাকার বেইলি রোডের উদয়ন লাইব্রেরির আলমগীর হোসেন বলেন, 'একটি খাতার দাম ২০ থেকে বেড়ে এখন ২৫ টাকা হয়েছে। পেনসিলের দাম বেড়েছে ২-৫ টাকা। সাধারণ মানের জ্যামিতি বক্স ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে ক্যালকুলেটরের দাম। অন্যদিকে, ৫ টাকার বলপেনে কালির পরিমাণ কমিয়েছে কোম্পানিগুলো'।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যায়। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
তার মতে, 'কৃষিপণ্য আধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থার প্রবর্তন করলে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার স্থায়ী সমাধান পাওয়া যেতে পারে'।
বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে এখন মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। বাড়ছে মাথাপিছু আয়। 'কাগজে-কলমে বাংলাদেশে এখন পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের মাথাপিছু আয় ৯০ হাজার টাকার বেশি। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন'- এ বিষয়টি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ড. সেলিম রায়হান।
'মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি সঠিক হলে– দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে দেশে এমন হাহাকার হতো না। ফলে পরিসংখ্যান যথাযথ হওয়াটা বেশি জরুরি এবং তার ভিত্তিতে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে'- যোগ করেন তিনি।