কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ বাড়িয়েছে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো
বকেয়া ঋণ আদায়ে ধীরগতি ও আমানতের সংগ্রহ কম হওয়ায় দেশের আর্থিক খাতে বেড়েছে তারল্য সংকট। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দৈনিক চাহিদা মেটাচ্ছে কয়েকটি ব্যাংক। চলতি মাসে প্রতি কার্যদিবসেই রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
এ খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, গত এক বছরের ব্যপক পরিমাণ ডলার কিনতে গিয়ে নগদ তারল্যেরও সংকট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রোববার (২১ আগস্ট) কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ধার নিয়েছে। এর আগে গত ১৭ আগস্ট সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা, ১৬ আগস্ট সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা এবং ১৪ আগস্ট সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এজন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সুদ গুনতে হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার পাশাপশি ব্যাংকগুলোতে স্বল্প সময়ের ঋণ কল মানি রেটের পরিমাণও বেড়েছে। চলতি মাস জুড়ে কল মানি রেট ছিল ৫ শতাংশের বেশি। যদিও আগের বছরে ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবকে সামনে রেখে প্রায় ৪ শতাংশের বেশি ছিল এর পরিমাণ।
বুধবার আন্তঃব্যাংক মানি মার্কেট লেনদেনের চিত্রে দেখা যায়, এদিন ৪১৬৯ কোটি টাকা লোনদেন হয়েছে যার রেট ছিল ৫.৫।
গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে মানি মার্কেটের রেট প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ। গত ৬ জুলাই রেট ছিল ৫.৪৮; তার পরেরদিনের রেট ছিল ৫.৮৫।
দেশের আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় গত অর্থবছরের আগস্ট থেকে ব্যাংকিং খাতে ডলারের ব্যপক চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কিনে তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ডলার সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ৭.৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সাড়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়।
গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ব্যাংকগুলোর ডলার সংকট চলতে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি কমাতে শতভাগ নগদ মার্জিনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
একইসঙ্গে জরুরি সরকারি আমদানি অব্যাহত রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ৪৭ দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ১৭ হাজার ৬০৩ কোটি টাকার বিনিময়ে ১.৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, এ বছরের জুনের শেষে ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত তারল্য দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদ অর্থ মাত্র ২০ হাজার কোটি টাকা। বাকি উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করছে।
এছাড়া জুন শেষে সরকারের কাছে ৩ লাখ ২২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে, অর্থাৎ এ পরিমাণ ব্যাংকের অর্থ সরকারের কাছে ঋণ আকারে রয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল আলম খান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন,
"অনেক ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে তাই তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ঋণ নিচ্ছে। তবে পূবালী ব্যাংকের এখনও তারল্য সংকট নেই। আমাদের আমানতের টাকা বাড়ছে। একইসঙ্গে আমানতকারি বাড়ছে।"
চতুর্থ প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, "ব্যাংকের নগদ তারল্যের সংকট রয়েছে। যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে তা দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ নিতে হচ্ছে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত রোববার একটি ব্যাংক দু দিন মেয়াদি রেপো সুবিধার আওতায় ২৭০ কোটি ৬৪ লাখ টাকার আবেদন করেছিল। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকার সংকটে পড়া ব্যাংকটিকে ১৩৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকটিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সুদ গুনতে হবে সাড়ে ৫ শতাংশ হারে।
অপরদিকে ৭ দিন মেয়াদি রেপো সুবিধার আওতায় পাঁচটি ব্যাংক ৯ হাজার ৩৮৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ঋণ চেয়েছিল, বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়া হয় ৪ হাজার ৬৯২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
অপরদিকে ১৪টি ব্যাংক দু দিন মেয়াদি বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ৭ হাজার ৪৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৪টি ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী পুরো অর্থঋণ দেওয়া হয়।
সব মিলে রোববারে ২০টি ব্যাংকের ১৭ হাজার ১০৮ কোটি টাকার চাহিদার বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয় ১২ হাজার ২৭৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ জন্য সুদ গুনতে হয় সাড়ে ৫ শতাংশ।